Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

সংকটের আবর্তে নোয়াখালীর ভূমিহীনেরা



সংকটের আবর্তে নোয়াখালীর ভূমিহীনেরা
মাহমুদুল হক ফয়েজ

মেঘনা ও বঙ্গপোসাগরঘেঁসা নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চল নানান ভৌগোলিক ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে অবস্থান করছে এ অঞ্চলের মানুষ একদিকে নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন নতুন ভূমি সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠছে একদিকে মানুষ ভূমি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে খাসজমি পেতেও তারা নানান বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে তা ছাড়া এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ দিনমজুরের কাজ করে প্রায় তারা নিত্য টানাপোড়নের মধ্যে অভাবি জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে

এখনো অনেকেই যুগযুগ ধরে বংশপরম্পরায় ভূমিহীন অবস্থায় রয়ে গেছে যদিও সরকারি নীতিমালায় নতুন খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়ার অধিকার এইসব ভূমিহীনদের রয়েছে কিন্তু সরকারি বিভিন্ন নীতিমালার বিষয়ে অজ্ঞতার কারনে এরা খাসজমি বন্দোবস্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই সব খেটে খাওয়া মানুষদের, যাদের নিত্য চাল আনতে পান্তা ফুরায় প্রতিদিন যাদের প্রচন্ড হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দুবেলা অন্ন জোগাতে হয়, জীবন যাদের শত ছিন্নতায় বাঁধা, তাদের তথ্যের পিছনে ঘুরে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য শক্তি ও সামর্থ্যের অবকাশ কোথায়
সার্বিকভাবে নোয়াখালীর ভূমিহীন সমস্যা অত্যন্ত প্রকট নদী ভাঙ্গনের ফলে নোয়াখালীর বিভিন্ন জনপদ প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে এই নদীভাঙ্গনের কারনে বৃহত্তর নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া, রামগতি ও কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ প্রতিবছর বাস্তুভিটা হারিয়ে প্রতিনিয়ত ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে স্বাধীনতার পরবর্তী কাল থেকে ভূমিহীনদের খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া শুরু হলেও আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক ভূমিহীন খাস জমি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে খাসজমি বন্দোবস্ত পেতে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও জটিলতা রয়েছে তা ডিঙ্গানো একজন সাধারন ভূমিহীনের পক্ষে অসম্ভব ব্যপার নতুন চর জাগলে ভূমিহীনরা সে চরে স্বাভাবিক ভাবে কখনো বসতি পায়না একটুকরো জমির জন্য তাদের অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হয় কখনো জড়িয়ে পড়তে হয় রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষে এখানে আছে ভূমিগ্রাসী জোতদার লাঠিয়াল বাহিনীর অত্যাচার এরা মধ্যযুগীয় কায়দায় দখল করে নেয় সরকারী খাসজমি গুলো সংঘাত সংঘর্ষ হামলা মামলায় হারিয়ে যায় ভূমিহীনদের একটুকরো বাঁচার স্বপ্ন
এসব কিছুর পরেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করেছে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন নীতিমালায় ভূমিহীনদের কিছু কিছু জমি বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে তবে প্রায় ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে যে, এর জন্য ভূমিহীনদের প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভূমিহীনদের নামে বেনামে জোতদাররা অনেক জমি নিজেরাই করায়ত্ত করে নিয়েছে
খাসজমি প্রদান ছাড়াও এরশাদ সরকারের আমলে গুচ্ছগ্রাম, বিএনপি সরকারের আমলে আদর্শ গ্রাম এব আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রভৃতির মাধ্যমে ভূমিহীনদের পূনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে নোয়াখালী সদর ও সুবর্নচরের চর মজিদ, চর মহিউদ্দিন , হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে কিন্তু এর মাধ্যমে ভূমিহীনদের মাথা গুঁজার স্থান হলেও তাদের অধিকাংশেরই জীবন জীবিকার নিশ্চয়তা মিলেনি সরেজমিনে দেখা গেছে অনেক বরাদ্ধপ্রাপ্ত ভূমিহীনরা আশ্রয়ণ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে
বাংলাদেশের ভূমিবন্দোস্ত নীতিমালায় ভুমিহীনদের রয়েছে অগ্রাধিকার বিভিন্ন সময় সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি করে থাকে কিন্তু ভুমিহীনরা সে বিষয়ে থাকে একেবারে অজ্ঞ এ সুযোগে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী লুটেরা চক্র ভুমিহীনদের সে সুযোগ ষোলআনা ভোগ করে নেয় ফলে প্রকৃত ভূমিহীনরা থাকে বঞ্চিত অবহেলিত নোয়াখালী সদরের সল্লা গ্রামের রিক্সা শ্রমিক আবুল কালামের(৪৫) শুধু ভিটির উপর দোচালার একটি ঘর রয়েছে তিনি প্রতিদিন সেখান থেকে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে সোনাপুর বাজার এবং এর আসেপাশে রিক্সা চালিয়ে থাকেন এছাড়াও বাড়তি কাজ হিসাবে অন্যের জমি বর্গাও করেন কিন্তু কিভাবে খাস জমি বন্দোবস্ত পেতে হয় তিনি তা জানেন না ভূমিহীনদের জন্য যে সকল প্রজ্ঞাপন জারি হয় তাও তিনি কখনো শুনেননি অথচ ভূমি অফিস গুলোর কাছাকাছি প্রায় তিনি যাত্রি নিয়ে যাওয়া আসা করে থাকেন সে অফিস গুলোতো এর অনেক তথ্য থাকলেও তার কাছে তা কখনো পৌঁছেনি শুধু শুনেছেন টাকা দিলে জমি পাওয়া যায় তিনি জানান প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এর জন্য খোঁজখবর নেওয়ারও ফুরসত থাকেনা তিনি আরো জানান, তার মত এ রকম আনেকেই আছেন যাদের এ বিষয়ে কোনো খবরই নেই সুবর্ণচরের অসংখ্য ভূমিহীন বেড়ির পাশে কোনোরকম মাথাগুঁজার ঠাঁই করে আছে আনেক আসহায় ভূমিহীন নারী ফসলি মাঠে কায়িক শ্রম করে আথবা সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলোর রাস্তা মেরামত বা মাটির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এদের আনেকেই উপায়হীন হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিও করে এদের পাশেই ভূমিগ্রাসিরা নানান কায়দায জমি দখল করে আছে কিন্তু এদের ভাগ্যে একটুকরো জমিও মিলেনি বেলী রাণী বনিক(৩৫)দের সন্দীপের কালাপানিয়াতে ছিলো বিপুল জায়গা জমি প্রায় দশ বছর আগে স্বামী ভূবন চন্দ্র বনিক মারা যায় নদীতে সব ভেঙ্গে গেলে দুটি কোলের শিশু নিয়ে নি:স্ব কপর্দক শূন্য হয়ে সুবর্ণ চরের শিবচরণ গ্রামের পশ্চিমে বেড়ির বাঁধে পাশে এসে আশ্রয় নেন সুঠাম দেহের বেলীরাণী জানান, গায়ের গতর খেটেই তিনি জীবন যাপন করছেন কখনো মাটিকাটা কখনো ধান ক্ষেতে বদলার কাজ যখন যা পান তাই করেন সকাল ৮টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করলে পান ৪০ টাকা এবং এক কেজি চাল তিনি জানান এত কষ্ট করার পরও কোথায় কিভাবে জমি পাওয়া যায় তা তার জানা নেই শুধু শুনেছেন, জমির জন্য গেলেই টাকা দিতে হয় তাই কখনো ঐদিকে পা মাড়াননি ভূমিহীন লক্ষীরাণী দাস(২৫) জানান তিনি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন এলাকার বিভিন্ন ক্ষেত খামারে বদলা দিয়ে কোনো রকমে আয় উপার্জন করেন তিনি জানান কিছুটা পড়ালেখা জানলেও খাস জমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত কোনো তথ্য তিনি জানেননা


ডানিডার একটি মাটির প্রকল্পে তাঁর সাথে আরো অনেক মহিলা এ কাজ করেন জাহানারা বেগম(৪০), ছকিনা খাতুন(৩৫), নূর জাহান বেগম(৫০), মিনতি রাণী পাল(৩৫), মোহছেনা বেগম(৪০) এই সব ভূমিহীন নারীরা কেউ জানেনা ভূমিহীনদের জন্য সরকারের কিকি নীতিমালা রয়েছে অথচ এদের সামনে থেকেই এদের অধিকারের ভূমিগুলো ভূমিগ্রাসীরা খাবলে খাচ্ছে আর এরা থেকে যাচ্ছে চির দীনহীন দিনমুজুরে ধীরে ধীরে নি:শেষ হচ্ছে এদের জীবনী শক্তি আর সর্বাঙ্গীনভাবে জাতি হয়ে পড়ছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর
নোয়াখালীর দক্ষিনাংশে সাগর থেকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভূমি জেগে উঠছে অথচ সে ভূমির সঠিক ব্যবহার কখনো করা হয়নি এদিকে আশংকাজনক ভাবে ভূমিহীনদের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে কোন এলাকায় কত জমি আছে তার সঠিক তথ্য ভূমিহীনদের কাছে কখনো পৌঁছায়না আর সে জমি গুলো নানান কায়দায় নানান ছল চাতুরিতে চলে যায় ভূমিগ্রাসীদের কব্জায় ভূমি নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে খাসজমি পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে একমাত্র ভূমিহীনদের অথচ অসহায় নিরক্ষর ভূমিহীনরা এর সুফল ভোগ করতে পারছেনা আবার এদের রক্ত ঘামে আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি সচল রয়েছে জাতী হিসাবে সর্বাঙ্গীন ভাবে আমরা অনেক পিছে পড়ে রয়েছি দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ভূমিহীন দেশের অর্ধেক জনগণকে বাদ দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধির কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র ভূমি সংক্রান্ত সঠিক তথ্য ভূমিহীনদের জানানো সরকারের গুরু দায়িত্ব সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ভূমিহীনদের কাছে সঠিক ভাবে খাসজমি বন্দোবস্ত দিতে পারলে কৃষি প্রধান এদেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনবে তা আর কাউকে বলার অপেক্ষা রাখেনা


দৈনিক প্রথম আলো
২৬ এপ্রিল, ২০০৮


BACK

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.