স্থানীয় সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
নানা ভাবে এখন সাংবাদিকতার প্রসার ঘটছে। যে কোনো খবর এখন আরো দ্রুততার সাথে সাংবাদিকরা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন । আগের তুলনায় নানান মাধ্যমে মানুষ আরো সহজে খবরা খবর জানতে পারছে। উন্নত যোগাযোগের ফলে মফস্বলের সাংবাদিকরা নানান স্থানে ঘুরে বস্তুনিষ্ট খবর সংগ্রহ করছেন। খবর পরিবেশনের মধ্যে যে মুন্সিয়ানা রয়েছে মফস্বলের সাংবাদিকরা তা ধীরে ধীরে বুঝতেও পারছেন। নানান প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাংবাদিকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁদের পেশাগত কাজে লাগাচ্ছেন। আগের তুলনায় প্রিন্ট এবং মিডিয়া সাংবাদিকতা অনেক বেশী শক্তিশালী। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা উপজেলায় শীর্ষস্থানীয় মিডিয়া গুলোর প্রতিনিধি রয়েছে। তবে দু’ একটি মিডিয়া ছাড়া মফস্বল সাংবাদিকদের তেমন বেতন বা অর্থ দেয়া হয়না। এ নিয়ে মফস্বল সাংবাদিকরা নানান সময় নানান ভাবে ক্ষোভও প্রকাশ করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত কাজ করছেন।
স্থানীয় সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় বাধা স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রায় এদের সাথে নানা ভাবে সমঝোতা করে চলেন। আর সমঝোতা না করে থাকলে তদের কপালে জোটে নানান দুর্ভোগ। তা ছাড়া স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মাঝে অশিক্ষা ও অজ্ঞতা তো রয়েছেই। কিছু স্বল্পশিক্ষিত অজ্ঞ সাংবাদিকদের কারণে স্থানীয় সাংবাদিকতা অনেক সময় হুমকীর মধ্যে পড়তে হয়।
সাংবাদিকতা পেশা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা। সাংবাদিক বলতে সকল সংবাদ সংশ্লিষ্ট সংবাদ কর্মীকেই বুঝানো হয়। ডাক্তার বলতে যেমন খ্যাতিমান জাতীয় আন্তর্জাতিক চিকিৎসক থেকে শুরু করে গ্রাম্য হাতুড়ি ডাক্তার পর্যন্ত সকল ডাক্তারকেই আমরা বুঝি। মানুষের রোগ চিকিৎসার জন্য যোগ্য ডাক্তারের বিকল্প নেই তেমনি সমাজ সংস্কারের জন্য যোগ্য সাংবাদিকতারও বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্যি মফঃস্বলে যাঁরা সাংবাদিকতায় এগিয়ে আসেন তাঁরা আনেকেই কোনোরূপ যোগ্যতা ছাড়াই এ পেশায় প্রবেশ করেন। এমন কি অনেক রাজনৈতিক কেডার ও মস্তানদেরকেও এ অঙ্গনে এসে মফস্বল সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেখা যায়। এমনও দেখা যায় জাতীয় কোনো দৈনিকের প্রতিনিধি হতে না পেরে নিজেরাই পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করছে। এ সব অবাঞ্চিতরা পেশি ও ক্ষমতার জোরে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান গুলোকেও জবর দখল করে কলুষিত করে তুলছে। স্থানীয় সাংবাদিকতাকে কব্জা করে এরা স্থানীয় ব্যাবসা বানিজ্য চাঁদাবাজি এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রিত করার অপচেষ্টা করে। তা ছাড়া অনেক সুযোগ সন্ধানীকে দেখা যায় কোনো না কোনো ভাবে এ অঙ্গনে এসে সাংবাদিকতাকে টাকা পয়সা কামানোর মোক্ষম মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছেন। এ সব ব্যাক্তিদের অনাহুত কর্মকান্ডে সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্থানীয় জনগন আর কলঙ্ক লেপন করে সাংবাদিকতার জগতে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের শিক্ষা দীক্ষা তেমন কিছু নেই। সাংবাদিকতার কোনো প্রশিক্ষণও নেই। কিন্তু তাঁরা যদি অতিউৎসাহী হয়ে স্থানীয় কোনো সমস্যা কিংবা স্থানীয় দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন তাহলে তা প্রায় হিতে বিপরিত হয়ে পড়ে। আনাড়ী ভাবে তারা যেভাবে সংবাদ লেখেন তা মান সম্পন্ন হয়না। তাদের পরিবেশিত সংবাদের ভাষায় সংশ্লিষ্ট মহল ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। তাই সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়ে সেই সংবাদকর্মীর উপর।
সকল মফস্বল অঞ্চলেই যে এই চিত্র তা কিন্তু নয়। সেখানেও সব ধরনের অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অনেকেই নিজের মত করে অনেকোটা নিজে নিজেই লড়ে যাচ্ছেন। কাজও করে যাচ্ছেন নীরবে। তাঁদের অনেকেই কোনো প্রেস ক্লাবের সদস্যও নন। অথবা তাঁরা সে সব প্রেস ক্লাবের বিপরিতে গড়ে তুলেছেন বিকল্প মোর্চা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় মস্তান আর প্রভাবশালীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। এমনকি অনেককে জীবনও দিতে হয়েছে।
এখন প্রযুক্তির নানান প্রসারে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এখন দক্ষতা ছাড়া সাংবাদিকতা করা কঠিন। বর্তমানে অনেক জাতীয় সংবাদ পত্র ও সংবাদ সংস্থা তৃণমূল পর্যন্ত তাদের কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তাদেরকে এই সব নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকতে হবে। যেন কোনোভাবেই কোনো অসৎ কেউ এ আঙ্গনে প্রবেশ করতে না পারে। তাছারা তাদের নিয়োগকৃত কর্মীদের নিয়োমিত প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করতে হবে। যে কোনো অসুদপায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যাবস্থা গ্রহন করা দরকার। ইতিমধ্যে অবশ্য কিছু জাতীয় পত্রিকা ও সংস্থা এ সব পদক্ষেপের ফলে অনেকেই সতর্ক হয়ে গেছেন।
স্থানীয় ভাবে যারা নিবেদিত সংবাদকর্মী তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তার জনা সমস্ত বিভেদের ঊর্ধে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেন যে কোন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে কোনো আক্রমন সন্মিলিতভাবে প্রতিহত ও মোকাবিলা করা যায়।
সকল অচলায়াতন ভেঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিকতা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশী প্রসার লাভ করেছে। তা সাংবাদিকতার জগতে আশার সঞ্চার করছে। নব উদ্দীপনায় নবীন সংবাদকর্মীরা এগিয়ে আসছেন। নিবেদিত সংবাদকর্মীদের অক্লান্ত সাধনায় এটি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপে গড়ে উঠছে। অসৎ মানুষের তুলনায় সৎ মানুষের সংখ্যা কম হলেও সত্য সুন্দরের সামান্যতম প্রকাশও আশাহত জনগনের মাঝে আশার সঞ্চার করছে। খুব ধীর গতিতে হলেও সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত নিবেদিত প্রাণ সংবাদকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে জাতীয় উন্নয়নের ধারা এগিয়ে যাচ্ছে। একদিন তা আরো অনেক দূর প্রসারিত হবে। একদিন ম্রীয়মান এ অঙ্গনটি নব কিশলয়ে আরো পুষ্পমঞ্জরিত হয়ে উঠবে। আজ সকলের প্রত্যাশা এ ধারা আনন্তকাল ধরে চলতে থাকুক।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
সাংবাদিক, গবেষক
e-mail: mhfoez@gmail.com
No comments:
Post a Comment