Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

মুক্তিযুদ্ধা মোস্তফার খবর কেউ রাখে না

মুক্তিযুদ্ধা মোস্তফার খবর কেউ রাখে না

মুক্তিযুদ্ধা মোস্তফার খবর কেউ রাখে না
মুক্তিযুদ্ধা মোস্তফার খবর কেউ রাখে না
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফার খবর এখন আর কেউ রাখে না। যিনি এই দেশের জন্য মানুষের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। রক্তাক্ত যুদ্ধে হারিয়েছিলেন আপন বড় ভাইকে। যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মক আহত হয়ে নিজেই এখন বিস্মৃতির অতলে ডুবে আছেন।

গোলাম মোস্তফার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নোয়াখালীর বিভিন্ন রনাঙ্গনে অশেষ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন আনছার বাহিনীর সদস্য। তার পিতা এবং এক ভাইও ছিলেন আনছার বাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৬ই মার্চেই নোয়াখালী টাউন হলে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রন কক্ষ। তখন শত শত আনছার অবসর প্রাপ্ত সেনাবাহিনী, পুলিশের বহু সদস্য স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। প্রথমে জিলা স্কুল ও পরে পি.টি.আইতে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মূল সদর দপ্তর। সে সময় তার পিতা জুলফিকার আহম্মদ, যুদ্ধে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে মোস্তফা ও ভাই হায়দারকেও সঙ্গে নিয়ে নেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মোস্তফার নোয়াখালীর ‘সি’ জোনের অধিনায়ক মোশারফ হোসেনের অধীনে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এই জোনে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে তার সবগুলো যুদ্ধেই তিনি অসীম সাহশিকতার সঙ্গে কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। অত্যন্ত সাহসি ছিলেন তিনি। নোয়াখালী শহরে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের ভেতর আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য বেশ কয়টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত করা হয়। সে সময় সুধারাম থানার পাশেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস ষ্টেশনে দ্রুত রিক্সা চালিয়ে তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিলেন এবং পরক্ষনেই সেখান থেকে ত্বরিৎ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর ভিতর সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় চন্দ্রগঞ্জে। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রায় সাড়ে চারশ’ সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমন করে। সেই যুদ্ধে মোস্তফার ভাই হায়দার শহীদ হন। মোস্তফার কানের পাশে মাথায় গুলি লাগলে মারাত্মক আহত হন তিনি। যুদ্ধশেষে ভাই হারানোর শোক আর মাথায় আহত হওয়ার যন্ত্রনা থেকে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। এখন মোস্তফা মাইজদী পুরানো বাসষ্ট্যান্ড, পৌরসভা, সুধারাম থানার সামনে প্রধান রাস্তার পাশে, হাসপাতালে এলাকায় কখনো হাত নেড়ে নেড়ে বিড় বিড় করে অস্পুষ্ট স্বরে কি সব বলতে বলতে দ্রুত হেঁটে যান। কখনো উদাস দৃষ্টি নিয়ে কিছু বলতে চান। এখন সবাই তাকে পাগল বলেই জানে। শহরের পশ্চিম পার্শে জেলখানার পরেই তার বাড়ী। দশ/বার বছর আগে বাবা মোরা গেছেন। মাত্র ক’দিন আগে মাও মারা যান। অনেক কষ্ট আর যন্ত্রনার বোঝা নিয়ে এতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি। এক ছেলে যুদ্ধে হারিয়ে গেছে আর এক ছেলে থেকেও নেই। বৃদ্ধা মাও এতদিন শোকে দুঃখে পাথর হয়ে ছিলেন। মোস্তফার দু’ছেলে দু’মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। শত কষ্টেও স্ত্রী তাকে ছেড়ে যায়নি। এক ছেলে বাসষ্টেশনে টেম্পো, বেবীটেক্সি ধোয়া মোছার কাজ করতো। এখন টেম্পুর হেলপার। বড় ছেলে খেটে খুটে চলতে চেষ্টা করছে।
বিশেষ বিশেষ দিনে নোয়াখালি জেলা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হয় নানান অনুষ্ঠান। আসেন প্রশাসনের কর্মকর্তা সংগঠক অভ্যাগত অতিথি মাইক ফাটিয়ে বুক উঁচিয়ে আলোচনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা ভাব দেখায় কেউ কেউ উদাস দৃষ্টি নিয়ে মোস্তফা সব দেখেন। ভাবনায় জট বাঁধেন। মুখে তৃপ্তির স্মুতি আর সেই বীরত্বের স্মৃতিময় রোমন্থনই হয়তো তখন করেন মোস্তফা। তার অন্তরের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ মানুষটি কি তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তখন তিনি কি অস্ফুট স্বরে বলে উঠেন, ‘আজ কে পাগল? যে জীবনের সমস্ত বৈভব বিসর্জন দিয়ে এক টুকরো স্বাধীন স্বদেশের জন্য উৎসর্গ করলো নিজেকে, নাকি প্রিয় স্বদেশে বিচরনরত এই উদাস উদ্ভ্রান্ত সমাজ? বার বার প্রশ্ন করেন, ‘কে পাগল?’ আমরা যারা নিজেদের সুস্থ বলে নিয়ত দাবি করছি, মোস্তফার ভেতরের সেই অস্ফুট বেদনার কথা কোনদিন কি কান পেতে শুনতে পেয়েছি?
মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙ্গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হয়। দান অনুদান পেয়ে অনেকের পকেট ভারী হয়। টাকা গাড়ী বাড়ীর মালিক হয়েছেন অনেকে। দেশ স্বাধীন না হলে যাদের কোন অস্তিত্ব থাকতো না তারা আজ সমাজের প্রতিভু, সম্পদশালী, সমাজপতি। খবর হয় বিত্তবানদের, উঁচু তলার, আর অসুস্থ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় যাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে শত্রুমুক্ত হয়েছে তারা। তাদের চিকিৎসাও হয় না। আশ্রয় মেলে পুঁতিগন্ধময় নর্দমা আর ফুটপাথে। বিজয়ের মাস আসে, বছর চলে যায়, ওদের খবরটিও আজ আর কেউ রাখে না।
মোস্তফা বলেন, বিজয়ের মাসে ওকে দেখতেও কেউ আসে নি। গত বেশ কয়মাস মোস্তফা ঘর থেকে বের হন নি। ভাঙ্গা একচালা স্যঁতস্যঁতে ঘরে অসুস্থ পড়ে আছেন। পরিচিত পরিজন কাউকে দেখলে হেসে হেসে যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন করতে চেষ্টা করেন।
নোয়াখালী মুক্ত হয়েছিলো ৭ই ডিসেম্বর। সেদিন নোয়াখালীর পশ্চিমাঞ্চল থেকে মোস্তফার দল মার্চ করে ছিলেন শহরের দিকে। বীরদর্পে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা ঊড়িয়ে ছিলেন তিনি। হেসে হেসে বলেন, এখন আবার সেই পতাকা উড়াতে চান।

এখন এমনকি কেউ নেই। যিনি এই অসুস্থ বীর মুক্তিযোদ্ধার পাশে এসে দাঁড়াবে?


প্রকাশিত
মুক্তকন্ঠ
Posted by Mahmudul Huq Foez

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.