হাঁসের রাজা শহর আলী
মাহমুদুল হক ফয়েজ
এক বুক জল নিয়ে এঁকেবেঁকে তিতাস নদী ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কোল ঘেঁষে
চলে গেছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। নাসিরনগর উপজেলার কাছে এসে একবার বেঁকে গেছে তিতাস। যে
জায়গাটিতে এসে বাঁক খেয়েছে তার নাম ‘হরিণ বেড়ের বাঁক’।
তবে
এখন বাস্তবে
সত্যি সত্যি দেখা যাবে জল ছল ছল হাওরের নীল জলে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য পাতিহাঁস। নদী
ছাপিয়ে পাশের অগভীর বিলে হাঁসেরা ডুবছে, ভাসছে। ডুব দিয়ে শামুক তুলে ওপরে গলা বাড়িয়ে গিলছে। আবার
ডুব দিচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে অদূরে ডিঙ্গি নৌকায় বসে পাহারা দিচ্ছে হাঁসের রাখাল।
হাওর অঞ্চলে হাঁস পালন এখন অনেকেরই লাভ জনক পেশা।

শহর আলী জানান, তিনি
কোনো দিন পড়ালেখা করেননি।লিখতে পড়তে জানেন না। তার মূল বাড়ি পার্শ্ববর্তী বুড়িশ্চর
ইউনিয়নে। তার নিজস্ব দেড় একর জমি আছে। হাওরের মধ্যে সে জমিতে সামান্যই চাষ হয়। বাবা মৃত আরজু মিযা
এটা-ওটা কাজ করতেন। বাবার সঙ্গেই থাকতেন শহর আলী। বাবা মারা যাওয়ার পর ডিমের ব্যবসা
শুরু করেন। তার থেকে ডিম নিয়ে অনেকেই তুষের ভেতরে ডিম রেখে বাচ্চা ফুটাত। অনেকে
আবার গ্রামীণ পদ্ধতিতে মুরগির নিচে ‘তা’
দিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফুটায়। শহর আলী
দেখেন এতে ডিম বিক্রির চেয়ে লাভ একটু বেশি। শহর আলী সে কাজটিই কিছুদিন করেছিলেন। তারপর ভাবলেন, হাঁসের
খামার করলে কেমন হয়। নিজের ঘরেই তুষের মধ্যে ডিম রেখে ‘তা’ দিয়ে বাচ্চা
ফুটিয়ে শুরু করলেন খামার। যত্ন আত্তিতে বাচ্চাগুলো বড় হলো। ধীরে ধীরে তার খামারও
বড় হতে লাগল। ‘৭৫ সাল থেকে শহর আলী ডিমের ব্যবসা করেন। তিনি জানান, তখন
ডিমের হালি ছিল ১২ আনা। হাসের খামার যখন প্রথম শুরু করেন তখন তার হাঁসের
সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০। ধীরে ধীরে সেটি বেড়ে এখন হয়েছে এক হাজার দুই’শতে। শহর আলী জানান, প্রতিদিন
গড়ে খামার থেকে সাড়ে চার’শ থেকে পাঁচ’শ ডিম পাওয়া যায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে ডিম তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে
যায়। তার খামারে ছয়জন নিয়মিত কাজ করে।
প্রত্যেককে খাওয়া দাওয়া দিয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। কর্মচারীর বেতন, ঔষধ
খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয় মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। শহর আলী জানান, লোকসান
তেমন নেই। তবে মাঝে মধ্যে
লাভ কমে যায়। তার মুখে মুখেই হিসাব। লাভ যা হয় সংসার আর খামারের খরচ হয়। খামার ও দিন দিন বড় হচ্ছে। লাভ যেমন হয়, তাকে
কষ্ট ও করতে হয় খুব। শহর আলী বলেন,
এ কাজে ‘বেতালা মিন্নত, বারিষাত
পানিতে কামড়ায়। বাইনে বাইনে থাইকলে জ্বর জারি অয়’। শহর আলীর অসুখ বিসুখ হলে গ্রামের রাখাল ডাক্তারের ওপরই ভরসা। শহর আলী বলেন,’ ‘রাখাল
ডাক্তার কিতা কিতা ঔষুধ দেয়, খাইলে বালা হইয়ে যায়’।
হাওর অঞ্চলে হাঁস পালনে আছে এক
বৈচিত্র্য। শহর আলীর গ্রামের আরো ১৪-১৫টি ছোট ছোট খামার আছে। এদের মধ্যে তার খামারটিই
সবচেয়ে বড়। এই নাসির নগরের উত্তরে আছে আরো বড় বড় হাওর। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিং, সরাইল, ধরন্তি, লাখাই প্রভৃতি
হাওরাঞ্চল। এগুলোর ছয় মাসই পানিতে ডুবে থাকে। পূর্ব ভাগের লাগ-উত্তরে মেদীর হাওর।
এই বিশাল অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে ধানের চাষ হয়। তখন বুঝাই যায় না এক সময় এখানে এত
পানি ছিল। মনে হয় বর্ষা
শেষে কোনো পাতাল দেবতা বুঝি এক চুমুকে পানিগুলো গিলে নিয়েছে। তবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
সব হাওরে একই সময়ে পানি কমে না। উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। উত্তর দিকে
যখন পানি কমতে থাকে তখন শুকনো হাওরে হাঁসের খাওয়া কমে যায়। সে সময় খামারিরা
দক্ষিণে ভাটি অঞ্চলের খামারিদের কাছে হাঁস বিক্রি করে দেয়। উজানের বিল যখন শুকনো, ভাটিতে
তখন ঝিরি ঝিরি পানি। ভাটিতে হাঁসের খাওয়া পাওয়া যায় প্রচুর। উজানে তখন টান ‘ময়াল’ আর
ভাটিতে তখন ডুবা ময়াল। এই ডুবা ময়ালে হাঁসেরা সাচ্ছন্দে বিচরণ করে।
বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে হাঁসের খামারিদের মধ্যে
রয়েছে চমৎকার লেনদেনের পালা। এতে নিজেদের হাঁসগুলো আদানপ্রদান হয়। শীতে উজান যখন
শুকিয়ে যায় সে সময় হাঁসদের খাওয়া কমে যায়। তখন খামারিরা ভাটি অঞ্চলের খামারিদের
কাছে হাঁস গুলো বিক্রি করে দেয়। আবার যখন
বর্ষায় উজানে আগেভাগে পানি আসে তখন ভাটি অঞ্চলের খামারিরা ফের উজানের খামারিদের
কাছে হাঁসগুলো ফিরতি বিক্রি করে দেয়।
হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন খামারিয়া জানিয়েছেন, পাঁচ
বছর পর্যন্ত হাঁসগুলো ডিম দেয়। তাই তারা পাঁচ বছরের বেশি খামারে হাঁস রাখে না। শহর
আলী নিজে পড়ালেখা না করলেও তার ছেলেমেয়দের পড়ালেখা শেখাচ্ছেন। তার চার ছেলে আর
একমাত্র মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। বাকি দু ছেলে এখনো ছোট। তার স্ত্রী হাজেরা খাতুন
আরবি পড়াশোনা জানেন। তার ইচ্ছা ছেলে মেয়েদের সবাইকে পড়ালেখা করাবেন। পূর্ব ভাগ
ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদ আহমেদ জানিয়েছেন,
এ অঞ্চলে হাঁসের খামার করার যথেষ্ট
সম্ভবনা রয়েছে। বর্ষার এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক আহার পাওয়া যায়। বিনা পয়সাতেই এগুলো
পাওয়া যায়। খামারিরা অনেকেই জানান,
সরকারির তেমন কোনো সহযোগিতা তারা পায়
না। একটি বেসরকারি সংস্থা
থেকে তারা প্রতি হাঁসের জন্য ৫০ পয়সা
হারে টিকার ব্যবস্থা করে।
শহর আলী জানান, হাওরে
পানি কমে গেলে জমির মালিকরা জমিতে ধান রোপন শুরু করে। তখন হাঁসের চলাফেরায় বেশ
সতর্ক থাকতে হয়। জমিতে জালা তৈরির জন্য যখন ধান ছিটানো হয় তখন খুব বেশি সাবধান হতে
হয়। সে সময় তারা সে জমির পাশ দিয়ে হাঁস নিয়ে যান না। ধানগাছ একটু বড় হলে আইলের
মধ্য দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে হাঁসেরা চলাচল করে। কোনো অবস্থাতেই তারা ছোট চারাগাছের
জমিতে নামে না। এখানে আর একটি ব্যাপার লক্ষনীয় যে,
ধান গাছ যখন বড় হয় তখন ধানের গোছার ফাঁকে ফাঁকে হাঁস গুলোকে চরতে
দেয়া হয়। কারণ ধানে যদি কখনো পোকা লাগে তখন হাঁসেরা সে পোকা খেয়ে ফেলে। ধানের
গোড়ায় গোড়ায় হাঁসদের চলা চলের ফলে প্রাকৃতিক ভাবে নিড়ানির কাজও হয়। হাঁসদের
বিষ্ঠায় জমির ঊর্বরতা বাড়ে। এতে ফসল ভালো হয়।
শহর
আলীর ভাষা ও ইঙ্গিত হাঁসেরা স্পষ্ট বুঝতে পারে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, হাওরের মধ্যে
বিশাল এলাকায় হাজার হাজার হাঁস নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায় ‘আদার’ খুঁজে
খায়। নিদিষ্ট সময়ে শহর আলী ডাক দিলে সবকটি এসে এক জায়গায় জড়ো হয়। সন্ধ্যা নামার
আগেই হাঁসেরা দলবেঁধে ফিরে আসে তাদের আস্তানায়। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এ
অঞ্চলে বড় আকারের খামারি ছাড়াও প্রায় সব গৃহস্ত বাড়িতে হাঁস
পালন করে।
হাঁস পালন করেই শহর আলী আজ
আত্ননির্ভরশীল হয়েছেন। একজন সফল খামারি হিসাবে এলাকায় এখন তিনি সবার পরিচিত ।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
সেলঃ-
০১৭১১২২৩৩৯৯
Very good article! Your post is really helpful for me thanks for wonderful post.I am very happy to read your post Honours 2nd Year Result 2020 has been Published 2020 Check Your Result Download the Marksheet
ReplyDelete