আবুল কাশেমঃ পঙ্গুত্ব যাকে হারাতে পারেনি
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
আত্মনির্ভরশীলতার জ্বলন্ত উদাহরণ নোয়াখালীর এক অজপাড়াগাঁয়ের পঙ্গু আবুল কাশেম।
আবুল কাশেমের বাড়ীর কাছেই রয়েছে একটি বাজার। নাম তার মন্নান নগর। এক সময় এর নাম ছিলো গুলগুইল্লা বাজার। সোনাপুর চর জব্বর বেড়ী বাঁধের পাশেই গড়ে উঠেছে এ বাজারিটি। এ বাজার এক জাতের সুস্বাদু পিঠা তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলো। আটা ময়দা নারকেল গুড় দিয়ে এ পিঠা বানানো হয়। নাম গুলগুইল্লা। গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের প্রিয় পিঠা। দামেও সস্তা। একটি দুটি খেলে পেট ভরে যায়। মাটির কাজ ক্ষেতের কাজ করে অল্প পয়সায় খাওয়র জন্য এ বাজারে আসতো দলে দলে মানুষ। এই গুলগুইল্লাকে ঘিরে বাজারের নাম হয়ে যায় গুলগুইল্লা বাজার। আবুল কাশেম দেখলেন এই পিঠা বানাতে পা দিয়ে কোনো কাজ করতে হয়না। শুধু হাত দুটি ঠিক রাখলেই চলে। বানাতেও সোজা। পরিশ্রম বেশী হয়না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অল্প পরিশ্রমের এ কাজটি তিনি করবেন। বাজারের একটি পরিচিত চা দোকানে এসে এ কাজটি তিনি শুরু করলেন। প্রথমে গররাজি হলেও আবুল কাশেমের জোরাজুরির কারণে মালিক তাকে শেষ পর্যন্ত এ কাজে নিয়োজিত করেন। ধীরে ধীরে বাজরটি আরো বড় হতে থাকে। মানুষজনের চলাচলও বেড়ে যায়। শহরের সঙ্গে হয়ে যায় পাকা রাস্তার সুবিধা। মানুষের রুচিও পরিবর্তন হয়। শহরের ছোঁয়া পাওয়া মানুষ আর গুলগুইল্লা খেতে চায়না। তার পরিবর্তে মানুষ খেতে চায় পরটা। ইতিমধ্যে আবুল কাশেমও রপ্ত করেন অনেক কাজ। এক সময় বাজারের নামও পরিবর্তন হয়। সম্প্রতি নাম হয়েছে ‘মান্নান নগর’।
এই মান্নান নগরের বাজারে আবুল কাশেম নতুন উদ্যমে পরটা বানাতে শুরু করেন। এখন রীতিমত পরটার দক্ষ কারিগর তিনি। পরটার দোকানে পরটা বানাতে বানাতে আবুল কাশেম স্থানীয় ভাষায় বলেন,’আঁই হইর ন, আঁই হইসা লইনা, শহরের মুই যাই চান, যেতার আত এক্কান বেঁড়িয়া সেঁড়িয়া অই গেছে, হেতে হইসা খোজন শুরু করে। ইয়ান এতাগো ব্যাবসা। আঁই এগিন করিনা। ম্যাইনষের কাছে হইসা খোঁজন বালা ন, হিরা কইরলে মান সন্মান থায় না’। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, ‘আমি ভিক্ষুক নই, আমি পয়সা নেই না। শহরের দিকে তাকিয়ে দেখুন কারো একটি হাত বাঁকা-ছ্যাঁকা হয়ে গেলে পয়সা চাওয়া শুরু করে। এটা ওদের ব্যবসা। আমি এগুলো করিনা। ভিক্ষা ভালো নয়, ভিক্ষা করলে মান সন্মান থাকেনা’।
বাড়ি থেকে চার পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাজারে আসেন আবুল কাশেম। এসেই দোকানে পরটা বানানোর টেবিলের পাশে স্বাভাবিকভাবে হাত দিয়ে টেবিল ধরে হাতের ওপর পুরো শরীরকে শুন্যে তুলে পাশে রাখা টুলের উপর বসে পড়েন। যেন এক অভিজ্ঞ শরীরচর্চাবিদ নিখুঁত ভঙ্গিমায় জীবন সংগ্রামের কসরত করে যাচ্ছেন। বসা অবস্থায় বুঝাই যায়না তিনি একজন পঙ্গু লোক। বসা অবস্থাতেই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আটা ময়দা তেল নিয়ে শানকীর মধ্যে বড় পরটা বানানোর ময়দা মাখতে থাকেন। এক নিখুঁত কারিগরের মত কাজ করে যান আবুল কাশেম।
নিজের শরীরের দুটি পা নিঃশার। একটি চোখ নেই। তবু কী দারুন ইচ্ছাশক্তিতে আত্মনির্ভরশীলতায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হামাগুঁড়ি দিয়ে রাস্তায় হেঁটে যেতে অনেকেই ভিক্ষুক মনে করে পয়সা দিতে চান। তখনি ক্ষেপে যান আবুল কাশেম। কারো দয়ায় দাক্ষিণ্যে নয়, নিজের ইচ্ছাশক্তি আর সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চান তিনি। যারা রাস্তা ঘাট বাস কিংবা ট্রেনে একটু হাত বাঁকা করে পঙ্গুত্বের দোহাই দিয়ে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায় ওদেরকে ভীষণ ঘৃণা করেন এই আত্মমর্যাদাশীল মানুষটি। আবুল কাশেম মনে করেন, পরনির্ভরশীলতা গ্রাস করে রেখেছে ওদের। এই পরনির্ভরশীলতা আর পঙ্কিলতার জীবন একই সূত্রে গাঁথা। এক চোখ নেই তাঁর, কিন্তু কী ভীষণ বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তিনি। আবুল কাশেম গর্ব করে বলেন, ‘আমি ভিক্ষা নেই না, আমি কাজ করে খাই’। ইতি মধ্যেই নিজের আয়ে সুন্দর একটি ঘর বানিয়েছেন আবুল কাশেম এখনো বিয়ে করেননি। হয়তো এক সুন্দর পরিপাটি আগামীর স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
আমাদের দেশের মানুষ দেশের কাজ ফেলে বিদেশে পাড়ি দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের ওরা আমাদেরকে বলে মিস্কিন, ফকির, ভিক্ষুক। জাতির এক কলঙ্ক নিয়ে আমাদের শ্রমিকেরা বিদেশে পাড়ি জমায়। অক্লান্ত অসয্য পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে। তবু ওদের চোখে আমাদের মানুষেরা মিসকিন, আমাদের দেশ মিসকিনের দেশ। ওদের হয়তো কোনো দোষ নেই। আমদের পুরো দেশটাই পরনির্ভরশীল দেশ। অন্যের কাছে হাত না পাতলে আমাদের বাজেট হয়না। মাথা নীচু করে ঋণ না নিলে আমাদের উন্নয়ন হয় না। দেশ চলেনা। আমরা পথ খুঁজে পাইনা কীভাবে সে কলঙ্ক মোছা যাবে! আবুল কাশেম চোখে আঙ্গুল দিয়ে সে পথ দেখিয়ে দিলেন, পঙ্গু বলে জীবণ যুদ্ধে হারিয়ে যায় না কেউ। চাই ইচ্ছাশক্তি আর আত্মশক্তি।

আবুল কাশেমের দৃঢ় কথা গুলো ইথারে বার বার অনুরনিত হয়, আঁই হইর ন’, ‘আঁই হইসা লইনা’ । এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের আহংকারে গৌরবান্বিত এই আমরা কবে এক সাথে মাথা উঁচু করে বলতে পারবো, ‘আমরা ভিক্ষুক নই, আমরা পরনির্ভরশীল নই’। কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়, কবে আসবে সেই সোনালী দুপুর।
No comments:
Post a Comment