Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের এক সহযোদ্ধা

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের এক সহযোদ্ধা
নোয়াখালীর এ.কে.এম ছায়েদুল হক
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতীর শ্রেষ্ঠ গৌরব। সেই যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন নিঃসন্দেহে তাঁরা জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে নবাবগঞ্জে এক সম্মুখ সমরে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তাঁরই এক সাথি ছিলেন নোয়াখালীর এক বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে.এম ছায়দুল হক। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত তিনি অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন নবাবগঞ্জের বিভিন্ন রনাঙ্গনে। নোয়াখালীর সুধারাম থানার অন্তর্গত হাছানপুর গ্রামের মৃত নাজির মিয়ার পুত্র ছায়েদুল হক তখন ছিলেন বি.ডি.আর এর একজন হাবিলদার। তাঁর রেজিষ্ট্রেশান নম্বর ছিল ৬২০২। ১৯৭১ ইং সনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ৭নং উইং-এ নওগাঁর চকিলাম কমাত্তার ছিলেন। সেই সময় ৭নং উইংবেটেলিয়ান কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক। নওগাঁ থেকে চকিলামের দুরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। ২৬শে মার্চে সকাল ১১.০০ টায় মেজর নাজমুল হক খবর (মেসেজ) পাঠালেন চকিলামের সমস্ত পাকিস্তানী সেনাদের গ্রেফতারের জন্য। সেই সময়ই তিনি বুঝতে পারলেন একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বাঙ্গালীরা। কমান্ডারের নির্দেশ নিয়েই তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বন্দী করতে উদ্যেগ নেন। তখন সেখানে ছিলো ৯ জন পাকিস্তানি খান সেনা। ছায়েদুল হক অন্যান্ন সহকর্মীদের নিয়ে কৌশলে তাদের বন্দি করলেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লো চর্তুদিকে। যোগাযোগ হলো তখনকার গণপরিষদ সদস্য কাজী ওয়াসিম উদ্দিন আহাম্মদ এর সঙ্গে। তাঁর নেতৃত্বে জনসাধারনকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন গঠিত হয়। এ সময়ে নওগাঁর দামার হাটে বাংলাদেশের পতাকা ঊড়তে থাকে। ছায়েদুল হকের দায়িত্বে ছিলো দামার হাট থেকে পাঁচ বিবি পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা। ২০শে এপ্রিল রাতে ২০/২২জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে হরতকী ডাঙ্গায় খান সেনাদের আস্তানায় আক্রমন করেন। তিনি নিজেই সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে দেন। যুদ্ধে তাদের সম্বল ছিলো এল.এম.জি এবং সাধারন রাইফেল। সেই যুদ্ধে তিনি মারাত্মক আহত হন। তখন মেজর নাজমুল হক তার জীপে করে তাঁকে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দামারহাট দখল করে নেয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। যুদ্ধের এই ক্রান্তি লগ্নে দুর্ভাগ্য বশতঃ এক সড়ক দুর্ঘটনায় মেজর নাজমুল হক মারা যান। সহকর্মীরা তাঁর লাশ সোনা মসজিদে এনে দাফন করেন। হাসপাতাল থেকেই ছায়েদুল হক জানতে পারেন মেজর নাজমুল হকের মৃত্যু সংবাদ। ১৯শে জুলাই তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং তার পরদিনই কামারপাড়া মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে যোগ দেন। সেই ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। তিনি ছিলেন তরুন অ-বিবাহিত। মুখ ভরা ছিলো দাঁড়ি। প্রথম দর্শনেই এক অসীম ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনে হলো তাঁকে। অত্যন্ত দৃঢ় চেতা আর স্বাধীনতার জন্য ছিলেন পাগল। আর ছিলেন খুব চঞ্চল প্রকৃতির। তার সংগ্রহে ছিলো নানা দেশের মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন বই। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন সেগুলো। আবার সবাইকে দিতেন পড়ার জন্য। ছায়েদুল হকের বয়স তখন প্রায় চল্লিশ। কিন্তু তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট এই তরুনের প্রতি আপনাতেই যেন শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে এলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না তিনি। তার সহকর্মীদের তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। কোন যুদ্ধে যাওয়ার আগে সে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে প্রচুর ভাবতেন। যুদ্ধের কলাকৌশল আর আক্রমনের নিখুঁত ছক তৈরীতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যুদ্ধে সব সময় তিনি আগে থাকতেন। কামার পাড়া ইনর্চাজ ছিলেন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট এম.এ রহিম। ২৮শে জুলাই ছায়েদুল হক কামারপাড়া ক্যাম্প থেকে তরঙ্গপুর ক্যাম্পে আসেন। এখানে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে অনেক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এক মাস পর ২৯শে আগষ্ট তরঙ্গ পুর থেকে মালন ক্যাম্পে চলে যান। ১১ই সেপ্টেম্বর মালন ক্যাম্প থেকে মেহেদীপুর আসলে সেখান থেকেই শিবগঞ্জ থানার কলাবাড়ী পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প আক্রমন করেন। সেই ক্যাম্পে তারা উপর্যুপরি পাঁচ ছয়বার আক্রমন চালায়। এখানে বহু খান সেনা হতাহত হয়। সেখান থেকে তারা বালিয়া দীঘি আক্রমন করে শত্রুমুক্ত করে নেয়। সেখানেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেন। এ সময় যুদ্ধ খুব তুঙ্গে চলছিলো। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আক্রমনের পর আক্রমন করে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছিলেন। যুদ্ধও যেন সবাইকে নেশা ধরিয়ে দিল। কি করে পাকিস্তানি হানাদারদের খতম করে প্রিয় স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করা যায় এটাই ছিলো সবার সার্বক্ষনিক চিন্তা। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে সবাই বিশ্রাম নিতে বল্লে অসম্ভব রাগ করতেন এবং ক্ষেপে যেতেন। তিনি ক্ষেপলে কেউ মনে কিছু নিত না, যেন আরো উৎসাহ পেতো। তাকে সবাই আদর করে ডাকতো “সদর উদ্দিন” বলে। সবাইকে বলতেন ‘দেশকে শক্রমুক্ত করেই বিশ্রাম নিব’। ১৩ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচন্ড আক্রমন করে কলাবাড়ী দখল করে নেয়। এখানে বহুখান সেনা ও রাজাকার খতম হয়। ১৪ই ডিসেম্বর নবাবগঞ্জ আক্রমনের পরিকল্পনা করলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। সেই আক্রমনে সবার সামনে থেকে অনবরতঃ গুলি ছুঁড়তে থাকেন শক্রুর লক্ষবস্তুতে। হঠাৎ একটি গুলি এসে তাঁকে বিদ্ধ করে গেল। সেখানেই লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সাথে সাথেই শাহাদাৎ বরণ করলেন তিনি। তার মৃত্যুতে সবার মন ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু সে সময়ের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জামাল সবাইকে সাহস দিলেন। দ্বিগুন উৎসাহে ফের সবাইকে জড়ো করে আক্রমন শুরু করলেন। পরদিন ১৫ই ডিসেম্বর প্রচন্ড যুদ্ধের পর নবাবগঞ্জ মুক্ত হলো। এই দীর্ঘ ২৫/২৬ ঘন্টা শহীদ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ সেখানেই পড়ে ছিলো। তার লাশ সেখান থেকে উদ্ধার করে যথাযথ মর্যাদায় সোনা মসজিদে এনে মেজর নাজমুল হকের কবরের পাশেই চির শায়িত করা হয়। মৃত্যুর সময় তার পরনে ছিলো একটি লুঙ্গি, দুই পাশে পকেট ওয়ালা একটি হাফশার্ট, মাজায় বাঁধা ছিলো গামছা এবং দুই কোমরে ছিলো দু’টি গ্রেনেড।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহি উদ্দীন জাহাঙ্গীরের স্মৃতি সার্বক্ষনিক বয়ে বেড়াচ্ছেন ছায়েদুল হক। তরুন ক্যাপ্টেনের কথা মনে হলেই চোখে জল নেমে আসে তাঁর। তিনি অত্যন্ত যত্ন করে রেখে দিয়েনেছ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নিজ হাতে লেখা যুদ্ধকালীন পত্র, ভারতের বালুর ঘাট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ডাক্তারের পত্রসহ আরো অনেক মূল্যবান কাগজপত্র।
প্রায় ৭০ বছর বয়সের শক্ত দীর্ঘদেহী এই মুক্তিযোদ্ধা কৃষি কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এখন। সরকার থেকে সামান্য পেনশন পান। নোয়াখালী সদরের হাছানপুর গ্রামে নিজ বাড়ীতেই থাকেন তিনি। চার ছেলে, চার মেয়ে। বড় ছেলে বি.ডি.আর এ চাকুরী করেন।
নোয়াখালীর হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন হাই স্কুলে নবম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন। বিশ বছর বয়সে ১৯৫১ ইং সনে পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী নেন। সেখান থেকে ৫৮ ইং সনে তৎকালীন ই.পি আর এ যোগ দেন। একাত্তরে দিনাজপুর জেলার দামর হাট থানার চৌকিলাম বি ও পি তে কর্মরত ছিলেন। সরল সাধারন প্রকৃতির এই মানুষটির চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই। তাঁর ইচ্ছা যে মানুষ গুলোর রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হলো, এই দেশে তাদের আর্দশ যেন অটুট থাকে, কামনা করেন দেশের সকল মানুষ যেন স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে এখন তার মনে এই উপলব্ধি এসেছে যে, তার প্রিয় তরুন কমান্ডার বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের আত্মা এই বলে তৃপ্তি পাবে যে পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ দেশের জন্য তার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।

প্রকাশিত
মুক্তকন্ঠ


No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.