Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

কমান্ডার নূর মোহাম্মদ

কমান্ডার নূর মোহাম্মদ
মহান মুক্তিযুদ্ধের এক কমান্ডার নূর মোহাম্মদের অভিযোগ ‘আমার নাম সুকৗশলে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে’
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

‘আমার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা থেকে সুকৌশলে বাদ দেয় হয়েছে। শুধু তাই নয় পাকবাহিনীর দ্বারা অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও আজ পর্যন্ত আমাদের খবর কেউ রাখে নি। অথচ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো, স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো, সমাজে আজ তারাই দাপটের সঙ্গে টিকে আছে।’ কথাগুলো অত্যন্ত আক্ষেপ করে বল্লেন নোয়াখালী সদরের দিন মনি হাটের এক নির্যাতিত কমান্ডার নূর মোহাম্মদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে মৃত্যুর গহ্বর থেকে দ্বৈবক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। নূর মোহাম্মদ ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সিপাহী। তার পিতার নাম মনতাজ মিয়া। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নোয়াখালী সদরের অশ্বদীয়া ইউনিয়নে তরুনদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প গড়ে তুলেন। তিনি জানান ‘আমি তৎকালীন পাকিস্তান আর্মীর ই.এম.ই তে ছিলাম। আমার নাম্বার ছিলো ৭০২১৮০৬। আমি আর্মী থেকে রিজার্ভ পেনশনে আসি ১৯৬৬ সনে। সেখান থেকে আসার পর আমি বেকার অবস্থায় ছিলাম। এরপর একাত্তর সনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমরা অশ্বদীয়া ইউনিয়নে সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। সেই নির্দেশ মোতাবেকই আমরা কাজ করতে থাকি। সে সময় সুলতান মাঝিকে সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। পরে রাজাকাররা তাকে অত্যন্ত নৃসংশ ভাবে হত্যা করে। তার নেতৃত্বেই আমি এখানে কমান্ডার নিযুক্ত হই। তখন আমি দিনমনি বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার খুলি। এখান থেকে মির্ধারহাট, মৌলভী বাজার, বানদত্ত বাজার, আবদুল্লা মিয়ার হাট, পোলের গোড়া, কিল্লার হাট, এগুলোই আমার নিয়ন্ত্রনে ছিলো। এই সময় আমার সঙ্গে আরো কয়জন অবসর প্রাপ্ত আর্মীর লোক ছিলেন। এপ্রিলের শেষে হানাদার বাহিনী যখন চৌমুহনী থেকে মাইজদী আক্রমন করলো তখন আমি আমার ট্রেনিং প্রাপ্ত লোকদের ভারতে পাঠিয়ে দেই। আর যারা ভাল ট্রেনিং পেয়েছে তাদের নিয়ে এলাকায় কাজ শুরু করি। এ সময় কবিরহাট, চাপরাশিরহাট তালমোহাম্মদ হাট এগুলিতে আমরা ছোট খাট অপারেশন করি। তাল মোহাম্মদ হাটের এক অপারেশন শেষে দিনের বেলায় আমি দনিমনি বাজারে লুতুর চা দোকানে একটু ঘুমাচ্ছিলাম। তখন ছিলো রমজান মাস, শনিবার। তখন রাজাকাররা খুব জুলুম শুরু করে দিয়েছিলো। দোকানটি তখন বন্ধ ছিলো। এ অবস্থায় কবিরহাট থেকে পাঁচজন রাজাকার আসার সময় স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীর ইঙ্গিতে তারা আমাকে ঘুম থেকে উঠায়ে শক্ত করে বেঁধে রিক্সায় করে মাইজদী নিয়ে আসে। এ সময় তারা আমার কাঁধে একটি এল.এম.জি তুলে দিয়ে মাইজদী কোর্ট বিল্ডিং সংলগ্ন রিজার্ভ ক্যাম্পে নিয়ে ঢুকালো। বর্তমানে এটি রেজিষ্ট্রি অফিস। সারাদিন তারা মাইক দিয়ে শহরে প্রচার করলো নোয়াখালী পূবাঞ্চল ‘ডি’ জোন থেকে নূর মোহাম্মদ কমান্ডারকে হাজার হাজার গুলি খরচ করে অনেক কষ্টে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কোন এল.এম.জি ছিলো না। ছিলো থ্রি.নট.থ্রি রাইফেল। ওদের এল.এম.জিকে আমার কাঁধে দিয়ে তারাও নাটক করে। তাদের বীরত্ব জাহির করার জন্য এগুলো দেখায়। তারপর সন্ধ্যার আগেই আমাকে আবার এনে ক্যাম্পে ঢুকায়। তখন আমার হাত পা শক্ত নতুন পাটের রশি দিয়ে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে আমাকে পায়খানার রুমে (বাথরুমে) ঢুকায়ে ফেলে। কিছুক্ষন পর সেই রুমে পাঁচজন রাজাকার ঢুকলো। তারা ঢুকেই এলোপাথাড়ী অত্যাচার শুরু করলো। একজন খাতা কলম নিয়ে ছিলো, বাকী চারজনের হাতে ছিলো রড ও লাঠি। এরপর তারা জানতে চায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস'ান, গোলাবারুদের কথা। কিন্তু তারা আমার মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারলো না। এভাবে মারতে মারতে এক সময় আমার মাথা ফেটে ফিনকী দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। সেই দাগ এখনো আমার কপালে আছে। পিছনে পিঠেও একটি রাইফেলের দাগ আছে। এ সময় আমার মাথার রক্ত ছিটকে এসে তাদের গায়ে পড়লো। তারপর তারা আমাকে মৃত ভেবে সেখানে ফেলে রাখে। এদিকে আমার বাবা আমার খোঁজে রাজাকার ক্যাম্পে আসে কিন্তু তিনি আমাকে সে অস্থায় চিনতে পারেন নি। আমার সারা শরীর ফুলে বিভৎস ও বিকৃত হয়ে যায়। চেনার কোন উপায় ছিলো না। এভাবে সেখানে পাঁচদিন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পাঁচদিন পর হাফেজ আনোয়ার নামে একজন রাজাকার কমান্ডার সেই রুমে ঢুকে। এ সময় আমার একটু হুঁশ আসে। আমি তাকে বল্লাম, ভাই মুসলমান হিসাবে আমার মুখে একটু পানি দিন, আমি পাঁচদিন অনাহারে। তখন সে কাপড় উল্টায়ে ধরে বলে, ‘হা কর, আমি মুতে দি’। তখন আমি বল্লাম, আলহামদুলিল্লাহ, ভাই পানি লাগবে না। তখন সে চলে গেলো। তারপর শান্তি কমিটির নেতা প্রফেসর মহি উদ্দিন ও আবু সুফিয়ানকে বল্ল, এ বেটাতো বেঁচে গেলো। সে তো আমাদের কাউকে রাখবে না। এ কথা বলার পর আবু সুফিয়ান বল্ল একে মেজরের কাছে নিয়ে যাও। তখন তারা আমাকে তক্তার উপর শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর পা দিয়ে রিক্সায় করে পাকিস্তানি আর্মী ক্যাম্পে নিয়ে গেলো। ক্যাম্প ছিলো হাসপাতালে। সেখানে তাদের একজন আমাকে উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো ‘তোমার নাম কি’ আমি উর্দুতেই তাদের সাথে কথা বলতে থাকি। তাদেরকে আমার পাকিস্তানি আর্মিতে চাকুরীর কথা বল্লাম। তখন আর্মিরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিয়ে যেতে বল্ল। কিন্তু হাফেজ আনোয়ার সহ যুক্তি করলো আমাকে আজকেই মেরে ফেলবে। পথে আসার সময় এস.ডি.ওর ড্রাইভার আমাকে চিনে থানায় নিয়ে গেলো। তখন এস.ডিও সাহেব থানায় গিয়ে আমাকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জেল থানায় অন্যান্ন কয়দিদের সেবা যত্নে আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। তাপর ৭ই ডিসেম্বর যেদিন নোয়াখালী হানাদার মুক্ত হলো সেদিন আমি জেল থেকে ছাড়া পেলাম। ‘আজ আমার সবচেয়ে দুঃখ ও কষ্ট লাগে যখন দেখি স্বাধীনতা বিরোধীরা সবকিছু দখল করে আছে। আর আমরা না খেয়ে না দেয়ে অতিকষ্টে আছি। এমনকি আজ স্বাধীনতা বিরোধীরা সবকিছুতেই রাজত্ব করছে। আজ আপনারাই খবর নিতে এলেন ২৮ বছর আমাদের খবর কেউ এসে এ ভাবে নেয়নি।’ কমান্ডার নূর মোহাম্মদ আরো জানালেন স্বাধীনতার পর বঙ্গবঙ্গু সরকারের আমলে মরহুম সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার কচি মিয়ার রেডক্রসের সাদা গাড়ী তিনি চালিয়েছেন। জননেতা মরহুম আবদুল মালেক উকিলের ডিউটি তিনি করেছেন। কিন'ু কোন দিন কোন সুযোগ সুবিধা নেন নি। তারদিন গুলি এখন বড়ই কষ্টে আর অভাবে কাটছে। তার বয়স এখন প্রায় পঁচাত্তর বছর। একটি মাত্র মেয়ে। বিয়ে নিয়ে নিজের কাছেই রেখেছেন। যুদ্ধের স্মৃতিগুলো এতোদিনেও ধূসর হয়ে যায় নি তাঁর কাছে।

প্রকাশিত
মুক্তকন্ঠ

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.