Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

নোয়াখালীর বধ্য ভূমিগুলো অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে

নোয়াখালীর বধ্য ভূমিগুলো অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

প্রয়োজনীয় উদ্যেগ ও অবহেলার কারনে নোয়াখালী জেলার বিপুল সংখ্যক বধ্য ভূমি আজও অনাবিষকৃত রয়ে গেছে। স্বাধীনতার ত্রিশ বছরের মধ্যেও অনেক বধ্য ভূমি চিহ্নিত করা যায় নি। ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতার স্বাক্ষী এ সব বধ্য ভূমি ও গণকবর গুলো লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। অনেকেই ধারনা করছেন এই বধ্যভূমি গুলো খ্বুঁজে বের করে খনন করলে এখনো পাকিস্তানি হানাদারদের অনেক নৃশংতার স্বাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাবে। তা না হলে আমাদের গৌরব গাঁথা স্বাধীনতার মহান আত্মত্যাগ ও ইতিহাসের ঊজ্বল অধ্যায় গুলো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে একাত্তরের ২৬ শে মার্চ থেকেই নোয়াখালীতে শুরু হয় গণপ্রতিরোধ। এ সময় নোয়াখালী টাউন হল ছিলো মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রন কক্ষ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন ক্যাম্প ছিলো প্রথমে নোয়াখালী জিলা স্কুল ও পরে সুধারাম থানা ও পৌরসভা সংলগ্ন মাইজদী পি.টি.আই। যুদ্ধ শুরু থেকে প্রায় একমাস এখান থেকেই নিয়ন্ত্রন হতো বৃহত্তর নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় নোয়াখালী জেলা প্রসাশক ছিলেন মঞ্জুরুল করিম। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্তক সহযোগীতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর সাহসী ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়। টাউন হলে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রনে ছিলেন জননেতা আবদুল মালেক উকিল, শহীদ উদ্দিন এস্কেন্দার আবদুল মালেক, আজিজুল হক এম.এ সহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। এ সময় শত শত আনছার অবসর প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য ও বহু যুবক মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেন। এরপর পরই গঠন করা হয় মুজিব বাহিনী। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার মুজিব বাহিনী কমান্ডার নিযুক্ত হন তৎকালীন ছাত্র নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। অল্পক’ দিনেই তিনি তারুন্যদ্বীপ্ত ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলেন সুশৃঙ্খল মুজিব বাহিনী। নোয়াখালী সদর থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ফেনীতেও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলো। শহর ও গ্রামবাসী এ সময় হাজার হাজার রুটি বানিয়ে গুড় নারিকেল সহ শুকনো খাবার স্বেচ্ছায় টাউন হলে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরবরাহ করেছিলো। সে সময় টাউন হলের ভিতর শুকনো খাবারের স'পে ভরে গিয়েছিলো। ২২শে এপ্রিল পর্যন- নোয়াখালী শহর হানাদার মুক্ত ছিলো। পাকিস-ানি বাহিনী বিপুল সমরাস্ত্র নিয়ে লাকসাম সড়ক হয়ে ২০ই এপ্রিল চৌমুহনীতে এসে পৌঁছে। এ সময় হানাদার বাহিনী লাকসাম নাথের পেটুয়া, সোনাইমুড়ী, বগাদিয়া, কালার পোল বজরা প্রভৃতি জায়গায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অবশেষে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলে এসে তারা ঘাঁটি গড়ে তোলে। এ পথে আসার সময় হানাদাররা লাকসাম থেকে বেগমগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের গ্রাম গুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়। বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুলে এসে এখানে তারা মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে গড়ে তুলে। প্রথমেই তারা এ অঞ্চলের বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র চৌমুহনী বাজার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। টেকনিক্যাল স্কুলের পাশেই ছিলো সংখ্যা লঘু কুরি পাড়া। কুরি পাড়ার বিখ্যাত মন্দির এবং সমস- পাড়াটাই এরা নৃশংখ ভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। সমস- এলাকা ঘেরাও করে নারী পুরুষ শিশুসহ করে ছিলো। তার সঠিক সংখ্যা আজো অজানা রয়ে গেছে। এই টেকনিক্যাল স্কুলে এরা প্রায় সাত মাসেরও অধিকাল অবস্থান করেছিলো। এ সময় এরা এখানে মুক্তিপাগল নিরীহ বাঙ্গালীদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। স্কুলের আশে পাশে অসংখ্য গর্ত করে এরা শত শত মানুষকে মাটি চাপা দেয়। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী আবদুল মতিন জানায় যুদ্ধের সময় রাজাকাররা তাকে ধরে এনে এখানে কয়েকদিন ধরে নির্যাতন চালায়। সে সময় তিনি তাদের কিছু নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তাকে গুলি করে হত্যা করার জন্য পাকিস-ানি মেজর নির্দেশ দেয়। একদিন রাতে তাকে স্কুলের পার্শ্ববর্তী একটি গর্তের কাছে এনে গুলি করলে সে গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়। অলৌকিক ভাবে তখন মৃত্যুর গহ্বর থেকে তিনি পালিয়ে এসে জীবন রক্ষা করেন। স্কুলের পাশ্ববর্তী লোকজনদের কাছে জানা যায় স্কুলের আশেপাশে অনেক গর্ত রয়েছে। টেকনিক্যাল স্কুলের মত স্কুলেরই একটু উত্তরে কালার পোলের কাছে আছে আর একটি বধ্য ভূমি। কি্নতু সে বধ্য ভূমিগুলো এখনো অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে। মাইজদীতে তারা ঘাঁটি করে পি.টি আই ভবন এবং তৎকালে নির্মানাধীন সদর হাসপাতালের পাকা ভবনে। এখানেও তারা সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব হাসপাতালের পাশ্ববর্তী জনসাধারন জানায় প্রায়শই এরা নিরীহ মানুষজনদের ধরে এনে এখানে অমানুষিক নির্যাতন করতো। পরে তাদের হত্যা করে হাসপাতালের আশে পাশে নিয়ে মাটি চাপা দিত। প্রত্যক্ষ দর্শীরা হাসপাতালের অভ্যন-রে বর্তমান সুইপার কলোনীর পাশে এবং হাসপাতালের সীমানার পশ্চিমে দুটি স'ানের কথা ব্যাক্ত করেন। এই বধ্যভূমি দুটিতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান মাঝি ও বর্ষিয়ান আইনজীবি নগেন্দ্র কুমার শুরসহ অনেককে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। পি.টি.আই ভবনের পাশেই রয়েছে আর একটি বধ্য ভূমি। এখানে মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক ও তৎকালীণ পৌর কমিশনার নৃপেন কুমার পাল ও তার ছোট ভাই শিবেন্দ্র কুমার পাল সহ অনেককে নৃশংস ভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। পাকিস-ানি বাহিনীর দোসরদের কয়েকটি ঘাঁটি ছিলো শহরের আশে পাশে। এর মধ্যে ছিলো মাইজদী কোর্ট ষ্টেশন এবং তার দেড় কিলোমিটার উত্তরে নাহার বিল্ডিং এ। এখান থেকে তারা নিরীহ বাঙ্গালীদের ধরে নির্যাতন করে হত্যা করতো। নাহার বিল্ডিং এর দুই কিলোমিটার পূর্বে ফিরিঙ্গীপোল এখনো হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী হয়ে আছে। রাজাকাররা রাতের বেলায় কার্ফিউ দিয়ে পোলের উপর মানুষদের রেখে গুলি করে হত্যা করে খালের পানিতে ভাসিয়ে দিত। পোলের পাশ্ববর্তী চৌধুরী মিয়া ও দোকানদার গোফরান মিয়া জানিয়েছেন এমন কোন রাত ছিলো না যে তারা মানুষ হত্যা করে নি। কখনো কখনো দিনের বেলায়ও তারা মানুষদের এনে এখানে গুলি করে হত্যা করতো। মাইজদী কোর্ট ষ্টেশানের পাশেই রয়েছে একটি বধ্য ভূমি। রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এখানে মানুষ হত্যা করে পুঁতে রাখতো। কোর্ট ষ্টেশনের টোকাই বক্কিয়া ও পান দোকানদার আবুল কাশেম এর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো।
৮নং কালাদরপ ইউনিয়নে রামহরি তালুকে আছে আর একটি বধ্য ভূমি। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মধ্য সময়ে এখানে হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা সময়ে এখানে হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বহু বাঙ্গালীকে হত্যা করে। একাত্তরে হানাদার পাকিস-ানি বাহিনী নোয়াখালীতে যে ক’টি নির্মম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো তার মধ্যে সোনাপুরের শ্রীপুর গ্রাম অন্যতম। ১৫জুনে হায়নাদাররা শান- স্নিগ্ধ ঘন বসতিপূর্ণ সবুজে ঘেরা এগ্রামকে এক যজ্ঞ পুরীতে পরিণত করেছিলো। অমানুষিক ভাবে নির্বিচারে গুলি করে তারা গ্রামে শতাধিক নিরিহ মানুষকে হত্যা করেছিলো। গ্রামের ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছিলো। সে বাড়ীগুলোতে শুধু আগুন লাগিয়েই ক্ষান- হয়নি তারা। দগ্ধবাড়ীতে অনেকেই ছুঁড়ে গুলি করলে অনেক মানুষজন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। সে সময় প্রায় একশ’ জনের লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়। বাকীদের সনাক্ত করা যায় নি। সে সময় প্রানের ভয়ে অনেকেই জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলো। এদের অনেককেই এই গ্রামের মধ্যেই কবর দেয়া হয়।
একাত্তরের ১৯ই আগষ্ট সকালে বেগমগঞ্জের গোপালপুর বাজারে পাকবাহিনী বাজারের ভিতর থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে পোলের উপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। তাদের সে নৃশংতায় সেদিন ৬৫ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাজারের পাশেই তাদের কবরগুলো রয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ কালিন সময় জেলায় জ্ঞাত বধ্য ভূমিগুলো ছাড়াও সারা জেলায় অসংখ্য বধ্য ভূমি আজো অনেকের অজানা রয়ে গেছে। সেগুলোকে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে।


প্রকাশিত
মুক্তকন্ঠ

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.