Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

ভাঙ্গে নদী ভাঙ্গে গ্রাম

ভাঙ্গে নদী ভাঙ্গে গ্রাম
মাহমুদুল হক ফয়েজ


ভেঙ্গে যাচ্ছে রঘুনাথপুর। রামগতির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্রের মোহনায় মেঘনার কোল ঘেঁষে বিশাল সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামের পত্তন অনেক পুরোনো। সারা গ্রামের প্রধান কৃষি পন্য ছিল পান। প্রতিটি বাড়ীতে আছে পানের বরোজ। নদীর মোহনায় বসত থাকায় নদী ওদের হয়ে উঠেছে জীবিকার আর এক অন্যতম উৎস। সমুদ্র ফুঁসে উঠলে শক্ত পেশী দিয়ে সিনা উঁচিয়ে রুখে দাঁড়ায় ওরা। কিন্তু রুদ্র রুক্ষ নদী যখন ভাঙ্গন শুরু করে তখন অসহায়ের মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। রঘুনাথপুর পল্লীমঙ্গল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাত্র পঞ্চাশ হাতের মধ্যে চলে এসেছে নদী। গত দু’ বছর আগেও নদী এখান থেকে দেড় দু’ কিলোমিটার দূরে ছিলো। এরপর আউটার ভেড়িও প্রায় ভেঙ্গে গেছে। নবনির্মিত বিশ্ব ভেড়ি এখন হুমকির মুখে।
সুকেশ চন্দ্র মজুমদার ৩৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। এক সময় ভাল ফুটবল খেলতেন। কথা হচ্ছিল রঘুনাথপুর কমিউনিটি সেন্টারের উপর তলায় বসে। এটি স্কুলের অংশ। সেখান থেকে দেখা যায় নদী ভাঙ্গার তান্ডব। নদী এত কাছে চলে এসেছে যে কোন সময় তলিয়ে যেতে পারে এই বিশাল ভবনসহ পাশের পাকা হাই স্কুল ও সমগ্র এলাকা। তিনি বললেন, এই গ্রাম কোন সময়ই চর ছিল না। অনেক প্রাচীনকাল থেকেই এর বসতি। এ গ্রাম ভাঙবে কল্পনাই আসেনি কারও। ভেড়ি বাঁধের পাশে পন্ডিতের হাট। সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে। সেখঅনে ছিল পোস্ট অফিস, ছিল ৮০/৯০টি দোকান, রামগতির বিখ্যাত পানের বাজার। শেষ চিহ্নটি একটি মসজিদ, সেটিও অমিত-ক্ষুধা জল গ্রাস করে চলেছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পষ্ট দেখা যায় সাগর থেকে জেগে ওঠা চর গজারিয়া লাল চর। এত ভাঙ্গার মধ্যেও দেখা গেল স্কুলের ঘন্টা বেজে চলেছে। ক্লাস হচ্ছে, স্কুল চত্বর তবুও প্রাণচঞ্চল, কোলাহলে ভরা। এই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পাঁচশত ত্রিশ জন। দুই জন শিক্ষক তিন জন শিক্ষিকা। ভাঙনের ফলে প্রায় ত্রিশ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী কমে গেছে। ১১নং বড় খেরী ইউনিয়নটি সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে নদীতে। তবু ভাঙা আইল আর নদীর গর্জন উপেক্ষা করে কয়েকটি ছোট্ট ছেলেমেয়েকে দেখা গেল স্কুলে আসছে। মলিন বেশ ভূষা। ওদের কারও নদীতে ঘর ভেঙ্গেছে। কারও ভাঙ্গার মুখে। লিটু দাস, মরন দাস, শ্রী গোবিন্দ দাস, মালতি বৈষ্ণব, সন্ধ্যা বৈষ্ণব, শ্রীপদ চন্দ্র দাস, রাজিব, হুমায়ুন, রঞ্জিত, বেনু-ছোট কচি কচি মায়াভরা মুখগুলো। জীবনের শরুতেই মুখোমুখি হল কঠিন বাস্তবের। ভাঙ্গনের শব্দ এখন আর বিচলিত করে না ওদের।
কিরন চন্দ্র দাসের ছেলে কনক চন্দ্র দাস (৪০) ছিয়াত্তর সনে মেট্রিক পাস করেছে। তার নামেই একটি মহল্লায় বাজার ছিল। কনক বাবুর দোকান বলে পরিচিত ছিল তার দোকান। পাশেই ছিল তার বড় বাড়ি। নদীতে সব বিলীন হয়ে গেছে। বিশ্ব ভেড়ির উপর এখন আশ্রয় নিয়েছে। স্ত্রী অনিতা রানী দাস বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকা। ভাল গান গায়। চারটি মেয়ে ছন্দা, রাখী, তমা, পুজা। ছোট মেয়েটি ছাড়া সবাই স্কুলে পড়ে। কোন রকমে দোকান ঘরটি দিয়েছে ভেড়ি বাঁধের পাশে। সেখানে সাজিয়েছে পুঁজিহীন নিরাভরণ পসরা। মিষ্টি চেহারার তমা দোকানে এটা ওটা সদাই বিক্রি করছিল। মাত্র কুড়ি দিন হল এখানে এসেছে। উপায়হীন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ওদের জীবনযাপন। এত কষ্টের মাঝেও মুখের হাসি আর আতিথেয়তার একটুও কমতি নেই। রঘুনাথপুরের অনেকগুলো বড় বাড়ীর মধ্যে একটি ছিল সরকার বাড়ী। এ বাড়ীর সবাই নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এ বাড়ীতে নিয়মিত চলত নানা উৎসব। বিভিন্ন পূজা-পার্বণে বসত মেলা। আছে একটি পূজামন্ডপ। পূজার ঘরটি ছাড়া বাড়ীর সবই ভেঙ্গেছে। বাগানে গাছ-গাছালি যেটুকু পারা যাচ্ছে কেটে নিচ্ছে লোকজন। দুইশ’ আড়াইশ’ বছরের পুরনো গাছও ছিল এ বাড়ীতে। মন্দিরের একেবারে পাশ ঘেঁষে চলে এসেছে নদী। যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়বে। পাশেই বহু পুরাতন একটি বট গাছের নিচে একটি কালী মন্দির। তাজা লাল জবা ফুলের অর্ঘ্য সাজানো রয়েছে মন্দিরের সিঁড়িতে। রাক্ষুসী মেঘনার কাছে যেন শেষ নৈবেদ্য। ছোট্ট এক চিলতে উঠোনের বলাই মাঝির বাড়ী। নদীর ঢেউয়ের পানি ছিটকে পড়ছে উঠোনে। পাশে ছোট ধানের ক্ষেতে ধান লাগানো হয়েছে। এখনও চারা অবস্থায় আছে। চারদিকে কলা আর ফলের গাছ। দু’টি কলার কাঁদি কেটে রাখা হয়েছে শূন্য মটকার গায়ে ঠেস দিয়ে। ঘরের চাল খুলে নেয়া হয়েছে। ভরা যৌবনের রাবিতা দাস স্বামী দারমী দাসকে এটা ওটা বেঁধে দিচ্ছে। বিশ্ব ভেড়িতে আপাতত মাথা গোঁজার জন্য চলে যাবে ওরা। সমুদ্রে মাছ ধরে দারমী দাস। নদীর মত ভরা যৌবনে এসে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় মলিন হয়ে গেছে সকল আবেগ আর চঞ্চলতা। তবু থেমে থাকে না জীবন। ভাঙ্গা নদীর কিনারে একদল জেলে আসন্ন জোয়ারে সমুদ্রে যাবার আয়োজন করছে। ইলিশের জালগুলো তুলে ঠিক করে নিচ্ছে। নীরব নির্জনতা ভেঙ্গে আর একদল জেলে সমস্বরে ডাক দিয়ে নৌকা তুলছে উপরে। অদূরে কোথাও ঘু ঘু ডেকে চলছে একটানা। গাবের মিষ্টি সোঁদা গন্ধ। এক বৃহৎ নারিকেল গাছের ভাঁজে বসে একটি কাঠঠোকরা শক্ত ঠোঁট দিয়ে টুকে যাচ্ছে-ঠক্ ঠক্ ঠক্।

ভাঙ্গে নদী, ভাঙ্গে গ্রাম , ভাঙ্গে কোলাহল। তবু জীবন থাকে না থেমে। রুদ্র রুক্ষ নদী বার বার গ্রাস করে নেয়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্ন সাধ। মাঝে মাঝে জীবনের রুপালী সৈকতে কালো মেঘ ছুটে আসে হঠাৎ ছন্দপতন। তবু নদীর পাড়েই ওদের জীবন, প্রাণস্পন্দনের অনন্ত কোলাহল।

প্রকাশিত
মুক্তকন্ঠ’র বুধবারের সাময়িকী
১৯আগস্ট, ১৯৯৮

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.