বুলেট বিদ্ধ ক্র্যাচ
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
এতদিন কোনো বিষন্নতা মুনিরকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর যাই হোক সে জানে অন্ধকার মুখ লুকায় সীমাহীন জ্যোতস্নালোকে। তাই একদিন তার অন্ধকারও মুখ লুকাবে। দু ক্র্যাচের উপর দেহটা খাড়া রেখে ভাবছে মুনির। সামনে ক্যানভাসে বন্ধু মফিজের আঁকা মনিরের প্রেমিকার ছবি। বিশেষ বলে কয়ে এ ছবিটা আঁকিয়ে নিয়েছে সে। পিছনের অন্ধকার ফেলে রেখে আলোকের দিকে তাকিয়ে আছে শীলা। প্রায় বিবস্ত্র দেহ । চোখে অনেক পাওয়ার স্বাদ। যেন সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে লাভ করছে স্বর্গীয় অমৃত। মুনিরের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছে; ‘তুমি কি পেলে ? যুদ্ধ করে কী কী পেলে তুমি ? আমিতো পেয়েছি অনেক। বিবস্ত্রা হলাম। ধর্ষিতা হলাম । পেলাম বিরাঙ্গনা উপাধি। আর তুমি! ক্র্যাচে ভর করে অস্পৃশ্য হয়ে আছ।’
চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে অসে। মুখ ফিরিয়ে নিলো মুনির। মাঝে মাঝে তার এমন হয়। প্রেমিকা বিরাঙ্গনা হলো। নিহত হলো। যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের পা-টা হারালো মুনির। তবুও একটা তৃপ্তি যেন এতদিন ছায়া হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলো তাকে। তার খোঁড়া শরীরটাকে যেমন করে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো এতদিন এক জোড়া ক্র্যাচ, তেমনি ক্র্যাচ হয়ে বন্ধু মফিজ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো মনিরের ভাঙ্গা খোঁড়া হৃদয়টাকে। নতুবা অনেক আগেই নূয়ে পড়ে নীচে গড়িয়ে হারিয়ে যেত মনির।
যারা একদিন স্বাধীনতার বিরোধী ছিলো, তারা আজ রাতারাতি ফাও দেশ প্রেমিক সেজে মুঠি মুঠি সম্পদের মালিক হচ্ছে। বাড়ি গাড়ি প্রতাপে আজ তারা ঊর্ধে বহু ঊর্ধে।
আর মুনির! যে ভালোবাসাকে বুকে চেপে ধরে তুলে নিয়েছিলো রাইফেল। বনে জঙ্গলে ঘুরে ধর্ষিতা স্বদেশের ছবি দেখে বার বার জ্বলে উঠেছিলো। সেই ভালোবাসা আজ নিরুদ্দেশ। অথচ মুনিরতো কিছুই চায়নি। সে চেয়েছিলো শুধু তৃপ্তি। ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা। চেয়েছিলো লাল সবুজে ছাওয়া একটা স্বদেশের ক্যানভাস। এতদিন একটা তৃপ্তি পাওয়ার ঠিকানা ছিলো তার। গত রাত থেকে সে ঠিকানাও নেই।
মফিজ ছবি আঁকতো। ছবিতে ফুটিয়ে তুলতো নির্যাতন। চিনিয়ে দিতো সমাজকে। ‘যাদের তোমরা বন্ধু ভাব তাদের পরখ করে দেখ।’ কেউকেটাদের হিংস্র মুখচ্ছবি ফুটে উঠতো তার ক্যানভাসে। এই তার অপরাধ। রাতের আঁধারে সেই মফিজের বুকে বুলেট বিঁধলো। তার রক্তাক্ত অসার দেহ ঢলে পড়লো ক্যানভাসের উপর। রক্তে রক্তে একটা ছাপ হয়ে ফুটে উঠলো দারুন অর্থবহ একটা চিত্র। বুকের রক্তে রঙ বানিয়ে যে ছবি হলো, সে ছবি কথা বললো। অসহয় ভাবে মুনির চোখ রাখলো শীলার চোখের উপর।
আজ মুনিরের কেউ নেই। কেউ নেই। যার কাছে এসে শুনতো ভালোবাসার গান। রাত্রি পোহাবে বলে ভোরের পাখির কাকলী । ক্র্যাচ সেজে যে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো। মফিজ বলতো, ‘বন্ধু, স্বদেশকে তুমি যা দিয়েছো সেটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া’। সে মফিজ নেই। সে ছিলো মনিরের জন্য একটা অবলম্বন। তার এই কাঠের ক্র্যাচের মত একটা জীবন্ত ক্র্যাচ।
চারদিকে ভীষণ ভীড়। শোকাহত বিপুল জনতা। পুলিশ, সাংবাদিক। সবাই ভীড় করছে। একটা খাটের উপর সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে মফিজকে।
শীলার চোখের উপর থেকে মুখ সরাল মুনির। চেয়ে দেখলো মফিজ শুয়ে আছে। আর সেই মূহুর্তে মনির যেন দেখতে পেলো। ও নিহত মফিজ নয়, একটা বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত ক্র্যাচ সাদা চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
চৌমুহনী কলেজ সাহিত্য প্রতিযোগীতায় ১ম পুরষ্কার প্রপ্ত ১৯৭৪
No comments:
Post a Comment