Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

চরের আনন্দ চরের বিনোদন

চরের আনন্দ চরের বিনোদন
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

নোয়াখালী শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে চরনবগ্রাম। এক সময়ের দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চল। এখন ধীরে ধীরে সরগরম হয়ে উঠেছে। নবগ্রামেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট বাজার, কয়েকটি মুদি আর চায়ের দোকান। সন্ধ্যার পর যখন সমগ্র চরে নেমে আসে ভুতুড়ে নীরবতা তখন এ দোকানগুলোতে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। জেনারেটরের কল্যাণে জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি। কয়েকটি দোকানে ব্যাটারীতে চলে সাদা-কালো টেলিভিশন। কর্মক্লান্ত চরবাসী সামান্য আনন্দ ও বিনোদনের আশায় টেলিভিশন দেখতে ভিড় জমান এসব দোকানে। হতাশা, যন্ত্রনা আর বঞ্চনা দূরে ঠেলে মেতে উঠেন আনন্দে।

তবে টেলিভিশন দেখার জন্য তাদের গাঁটের পয়সাও খরচ করতে হয়। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ভেদে টাকার অঙ্কও বাড়ে কমে। শুক্রবারের সিনেমার জন্য তিন টাকা। নাটক, বাংলায় ডাবিং করা ছবি যেমন সিন্দাবাদ ইত্যাদি দুই টাকা এবং অন্য অনুষ্ঠানের জন্য দর্শকদের এক টাকা করে দিতে হয়। চায়ের দোকানে চায়ের দাম অতিরিক্ত। নবগ্রামের এক ভূমিহীন কৃষক আট/দশটি কিশোর-যুবককে নিয়ে গড়ে তুলেছে এক ব্রতচারী নৃত্য দল। দেখলেই বোঝা যায় তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। অথচ তাদের ঢোল করতালের বাদ্যের তালে তালে উঠে ছন্দ। হাজার দুঃখেও ওদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি আনন্দ উচ্ছাস।

চরের বাসিন্দাদের কেউ স্থানীয় নয়। নতুন চর উঠার পর নানা জায়গা থেকে আশ্রয়ের সন্ধানে এসে ডেরা বেঁধেছে চরে। নিজেদের প্রয়োজনে একে অপরের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে নিজেরাই গড়ে তুলছে সমাজ। সোনাপুর-চরলক্ষী সড়কের মাঝামাঝি ব্রিজবাজার এলাকা। এখানে একসময় নদী পারাপারের জন্য খেয়াঘাট ছিল। তখন নাম ছিল গাজীর খেয়া। এখানে এখন একটি লোহার বেইলি ব্রিজ হয়েছে। এলাকার লোকজন নাম রেখেছে ‘ব্রীজবাজার’। এই বাজারটি ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখন এখানে আছে প্রায় পঁচিশ ত্রিশটি বিভিন্ন শ্রেনীর দোকান। বিদ্যুৎ এখানে নেই। জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ ভাড়া দেয়া হয়। একটি ডায়নামার মালিক জাফর। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা পর্যন- ডায়নামা চলে। প্রতিটি ৬০ পাওয়ারের বাল্বের জন্য ছয় টাকা এবং একশ’ পাওয়ারের বাল্বের জন্য ১০ টাকা করে প্রতি রাতে দিতে হয়। তবে টেলিভিশন চলে ব্যাটারীতে। পাঁচ-ছয়টি দোকানে টেলিভিশন আছে। সবই সাদা-কালো। সোহেল ষ্টোর, মোস্তফা সরকারের চায়ের দোকান, বলির দোকান, শহীদের চায়ের দোকানে টেলিভিশন আছে। বিকাল থেকেই চলতে থাকে। সন্ধ্যার পর জমে উঠে। পয়সা দিয়ে টেলিভিশন দেখতে হয়। সিনেমার জন্য তিন টাকা। অন্যান্য অনুষ্ঠান ভেদে এক/দু’টাকা।

খোকন, মোঃ সেলিম, সিরাজ নিয়মিত টিভি দেখে। তারা জানালো পুরুষরাই বেশী দেখে। তবে স্বামীদের সঙ্গে মহিলারা মাঝে মধ্যে আসে। আব্দুল আলীর আছে সাইকেল মেরামতের দোকান। ব্রিজবাজারেই দোকান। জানালেন টিভিতে খবরই তিনি সাধারনত বেশী দেখেন। অন্য অনুষ্ঠান বেশী দেখা হয় না। এলাকার লোকজন খবর শোনা বা দেখার চেয়ে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো বেশী দেখে বলে তিনি জানান। তরুন বয়সি নুরুদ্দীনের এই এলাকাই বাড়ী। মাছের ব্যবসা করেন। চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি জানান, নিজেরা চাঁদা করে মাঝে মাঝে জারী গানের আসরের আয়োজন করেন। গত বছর ধান কাটার মৌসুম শেষে হাতিয়া থেকে একজন গায়ককে এনেছিলেন। গায়ককে দিতে হয়েছিল ৩৫০/- টাকা। এই এলাকায় গায়েন তেমন কেউ নেই। তবে ছিদ্দিক, নোমান, বয়ার বাজারের জামাল কিছু কিছু পারে। টিভি সেটের মালিকদের কাছ থেকে জানা যায়, টিভির নাটকগুলো এ অঞ্চলের দর্শকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোও তারা আগ্রহ নিয়ে দেখে। তবে নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের ভাল ভাল কথাগুলো সমাজে খুব প্রভাব ফেলে বলে অনেকেই জানান। ফতোয়াবাজ এখানে তেমন নেই। বেশরিয়তী বা বেদাতী বলে উগ্র ধর্মান্ধতাও নেই। এখানে খবরের কাগজ আসে না। শহর থেকে মাঝে মাঝে কেউ আনলে লোকজনে পড়ে।

নোয়াখালীর এই নিভৃত চরের মানুষদের কাছে বেঁচে থাকার সংগ্রামই প্রধান। নিরন্তর সংগ্রামে ক্ষুধার অন্ন জোগাতেই ব্যস্ত থাকে তারা। এছাড়া জোতদার, মহাজন, দানন ব্যবসায়ী, টাউট, দখলদার এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও বোঝা পড়া করতে হয়। আনন্দ বিনোদনের সময়গুলো ওদের কেটে যায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রত্যয়ে। তবু আনন্দহীন জীবনের মেঘাছন্ন আকাশের এক কোণে নীল আকাশ দেখার উচ্ছাসে ওরা মাঝে মাঝে প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। মেতে ওঠে আনন্দ আর বিনোদনে।


মুক্তকন্ঠ
ঢাকা শনিবার, ২৬ জুন, ১৯৯৯

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.