Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

বর্গা প্রথা : গ্রামীণ সামাজিক রীতির অতীত বর্তমান

বর্গা প্রথা : গ্রামীণ সামাজিক রীতির অতীত বর্তমান
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

শত শত বছর ধরে বর্গা প্রথা বাংলার গ্রাম-গঞ্জের অর্থনীতির এক উল্লেখযোগ্য বিধি ব্যবস্থা। বর্গা প্রথার গ্রামীণ উৎপাদন ও সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও একটি সুদূরপ্রসারী ইতবাচক দিক রয়েছে। সুদূর অতীতকাল থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা টানাপড়েনের পর সৃষ্টি হয়েছে ধনী আর গরীব। সমাজের এক সম্প্রদায়ের হাতে চলে গেছে সম্পদ আর পুঁজি। আর অন্য সমপ্রদায় পুঁজিহারা সম্পদ হারা হয়ে নিছক কায়িক শ্রমের ওপর টিকে আছে। শ্রমিকরাই সরাসরি উৎপাদনের সঙে জড়িত। শ্রমিকদের শ্রম কাজে লাগিয়ে পুঁজিপতিরা, মালিকরা ইচ্ছামাফিক মুনাফা অর্জন করে। মুনাফার স্পর্শ শ্রমিকরা কখনই পায় না। মুনাফা দুঃস্বপ্নের মত তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবার শ্রমিক-মালিক সম্পর্কেও একটি বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষে মানুষে ব্যবধানও সুষ্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু বর্গা প্রথায় রয়েছে এর ভিন্নতা। এ প্রথায় মালিকের সাথে শ্রমিক বা চাষীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক এবং মুনাফাতেও উৎপাদনকারী চাষীর আছে অংশীদারিত্ব।
গ্রামে এমন অনেক অবস্থাপন্ন ব্যক্তি রয়েছেন যাদের রয়েছে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সরাসরি নিবিড় সম্পর্ক। কৃষি জমি থাকলেও তারা সেই জমিতে গিয়ে কায়িক পরিশ্রম করে উৎপাদন করেন না। সাধারনত চাকরি, স্থানীয় ব্যবসা অথবা অন্য কোন কাজে তারা সম্পৃক্ত রয়েছেন। ছোটখাট পুঁজি নিয়ে বড় ধরনের কোন ব্যবসায়ে যেতে তারা পারেন না। তারাই মূলত বিভিন্নভাবে গুরু-ছাগল ইত্যাদি বর্গা দিয়ে থাকেন।
অপরপক্ষে যাদের কোন জায়গা-জমি কিংবা সম্পদ নেই, কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও ব্যাংকের দোরগোড়ায় এরা পৌঁছতে পারেন না। কারণ ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গেলে জমি কিংবা সম্পদ বন্ধক দিতে হবে। আবার ‘দাদন’ নিতে গেলে দিতে হবে চড়া সুদ। এ অবস্থায় বর্গ প্রথা অনেকটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত, একে অপরকে সহযোগীতা করার এক অতি পুরনো ব্যবস্থা। নোয়াখালীর ব্যাপক অঞ্চলে জায়গা-জমি বর্গা ছাড়াও গরু কিংবা ছাগল বর্গা করা বেশ জনপ্রিয়। এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে এরকম বর্গা প্রথা চালু নেই।
জয়নাল আবেদীন একজন অতি সাধারন কৃষক। সামান্য কৃষি কাজ ছাড়াও সে দিনমজুর হিসেবে অন্যের কামলা দেয়। ক’জন অবস্থাপন্ন পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সৎ ও পরিশ্রমী হিসেবে সে সমাদৃত। প্রথমে সে একজন পরিচিতের কাছ থেকে একটি গাভী নিয়ে বর্গা লালন করতে থাকে। এ গাভী পালণের জন্য তার অন্য কোন খরচই করতে হয়নি। সোনাপুরের অদূরে চরসল্লায় একটি ভিটির উপর তার ঘর। দু’মেয়ে-দু’ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। বাড়ীর চতুর্দিকে আইল আর ক্ষেতে প্রচুর ঘাস জন্মে। সেখানেই তার ছোট দুই মেয়ে আর স্ত্রী গরুটিকে মায়া মমতা দিয়ে লালন-পালন করছে। দেশী জাতের গরু, দুধ কম দেয়, মাত্র দুই লিটার, কিন্তু যা পাওয়া যায় তাই লাভ। দেশী জাতের হওয়ায় পরিবেশের সঙ্গেও গাভীটি বেশ মানিযে নিয়েছে। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝায় তাদের সহনশীলতাও আছে। একই ঘরের এক পাশে চালা দিয়ে রাতে গাভীটি রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর জন্য অতিরিক্ত কোন খরচ নেই বললেই চলে। একে পালতেও তাদের কোন অসুবিধা নেই। বরং পরিবারে অতিরিক্ত আরেক সদস্য পেয়ে তারা সবাই মহাখুশি। দুধের অর্ধেক মালিককে দিয়ে আসে রোজ। এভাবে গাভীটি আবার বাচ্চা দিলে আগের বাছুরটি তাদের লাভের অংশ হিসেবে থেকে যায়। সেটি বিক্রি হলে মালিক এবং সে উভয়ে সমান সমান ভাগ করে নেবে। এ ভাবে বিভিন্ন জন থেকে সে গরু নিয়ে বর্গা করছে। স্থানীয় হাট থেকে ছোট বাছুর কিনে এক দেড় বছর পর বড় হলে আবার হাটে বিক্রি করে। এতে প্রতিটি গুরু থেকে দেড় দুই হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। তাতে যিনি বর্গা দিচ্ছেন তারও লাভ হচ্ছে। এই বর্গা দেয়া-নেয়া অনেকটা বিশ্বাসের ওপরই হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানে কোন দলিল দস্তাবেজের প্রয়োজন নেই। আবার শ্রমিক-মালিকেরও কোন প্রশ্ন নেই। একজনের পুঁজি আর একজনের শ্রম। দুয়ে মিলে যে উৎপাদন তার সমান অংশীদার দু’জনই। অর্থাৎ অংশীদারিত্ব প্রথা। যেহেতু গরু কেনা-বেচা, লালন-পালণ, উৎপাদন তার হাতেই সুতরাং কোন ফাঁকি-ঝুকি কিংবা শ্রমিকের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা বা প্রতারণারও অবকাশ নেই। যত শ্রম তত উৎপাদন, যত উৎপাদন তত লাভ।
ফাতেমা খাতুন একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। ৩৩ বছর শিক্ষকতা করে তিনি এখন অবসর যাপন করছেন। শিক্ষকতা করার ফাঁকে ফাঁকে মাইজদী শহরেই তার বাড়ীতে সখ করে গাভী পালন করতেন। কাজের লোক ছাড়াও তিনি নিজে দেখাশোনা করতেন। তাজা গরুর দুধের প্রতি তার প্রচন্ড ঝোঁক। তার পরিবারের সবাইকে তিনি দুধের ব্যবস্হা করে আজীবন তৃপ্ত হয়েছেন। এখন বার্ধক্য বয়সে ইচ্ছা থাকলেও তা হয়ে উঠে না। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে রয়েছে তার সুন্দর সম্পর্ক, নানাভাবে সাহায্য করেন তাদের। জগদানন্দ গ্রামে সাঈদ মিয়া নামে একজন কৃষককে দু’টি দুগ্ধবতী গাভী বর্গা দিয়েছেন। গাভীগুলোর দাম পড়েছে পনের হাজার টাকা। প্রতিদিন তার ভাগের অংশের প্রায় দেড় লিটার দুধ তিনি পাচ্ছেন। এলাকায় দুধের বর্তমান বাজার দর বিশ/বাইশ টাকা। সে হিসাবে বছরে তিনি পান প্রায় দশ হাজার টাকার দুধ। এদিকে বাছুরটি বড় হলেও একটি মূল্য দাঁড়ায়। তা থেকেও তিনি অংশীদারিত্ব পাচ্ছেন। একই লাভ সাঈদও পাচ্ছেন। কোন প্রকার পুঁজি ছাড়াই গাভীগুলোকে আদর-যত্নসহ লালন-পালণ করে চাষী সাঈদ মিয়া এ লাভের মালিক হলেন। অন্যান্য কাজ করেও তিনি এ লাভ উদ্বৃত্ত হিসাবে পাচ্ছেন। একটি জরিপে দেখা গেছে, লগ্নিকৃত পুঁজির প্রায় আশি শতাংশ লাভ উঠে আসছে এ পদ্ধতিতে। ফাতেমা খাতুনের মত গ্রামের অনেক অবস্থাপন্ন ব্যক্তিও এ পদ্ধতিতে বর্গা দিয়ে থাকেন।
মেহেরুন্নেছাও একজন স্কুল শিক্ষিকা। একুশ শ’ টাকা দিয়ে তিনি ফরাজী নামে একজন চাষীকে দিয়েছেন একটি ছোট বাছুর। এক বছর পর বাছুরটি বিক্রি হয়েছে চবার হাজার টাকায়। লাভের ১,৯০০/- টাকা তারা দু’জন ভাগ করে নিয়েছেন। এভাবে গ্রামের অনেকেই এ প্রথার সঙ্গে জড়িত হয়ে আছেন। সামাজিক সৌন্দর্য্য আর বন্ধনও অটুট রয়েছে। গ্রামের ইব্রাহিম মিয়া, চৌধুরী মিয়া, মফিজ উদ্দিন এর সবাই এ পদ্ধতিতে বর্গায় গরু পালছেন।
রাজনীতি সচেতন একজন সমাজকর্মীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করলে তিনি জানালেন, ‘পরিকল্পিতভাবে এ পদ্ধতিকে আমরা সাংগঠনিক আকারে গ্রহণ করলে সুদূরপ্রসারী এক ইতিবাচক দিকে সূচনা হবে।’ অবস্থাপন্ন ধনীদের এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারা এক বিরাট অবদান রাখতে পারবেন।
বিদেশী অনেক তত্ত্ব, পরিকল্পনা আর উন্নয়নের সূত্র নিয়ে আমরা নিয়ত গলদঘর্ম হচ্ছি। অথচ আমাদের দেশেই হাজার হাজার বছর ধরে যে মানবিক সামাজিক রীতিগুলো বিদ্যমান রয়েছে তার রেশ ধরেই আমরা উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছতে পারি। আমাদের আছে বিপুল জনশক্তি আর উর্বর মাটি। সমৃদ্ধির বীজ আমাদের মাটির মধ্যেই প্রোথিত। একটু সচেষ্ট হয়ে যত্ন করলেই তা থেকে আমরা কাঙ্খিত ফল লাভ করতে পারব।

মুক্তকন্ঠ
বুধবার, ৭ অক্টোবর, ১৯৯৮

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.