Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

চর সল্লার অজিফা খাতুন

চর সল্লার অজিফা খাতুন
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মানবিকতার প্রতিচ্ছবি

একজন অজিফা খাতুন। জীবনের নানান ঘাত প্রতিঘাত আর চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন এসে দাঁড়িয়েছেন শত বছরের দ্বার প্রান্তে। মুখের কুঁচকানো চামড়ায় কোটরাগত চোখের দৃষ্টি দিয়ে দেখেন দূর পিছনের ফেলে আসা তার জীবনের শুরুর দিনগুলোকে। নিমগ্ন চিত্তে দেখেন নিজের বিবর্ণ ছায়া। একা , শুধু একা, কেমন করে জল কাদায় মিশেলো তার জীবনের এতটা সময় পার করে এসেছেন। সেই ধূসর দিনগুলোর কিছু কিছু স্মৃতি এখন মাঝে মাঝে তার কাছে ঝক ঝকে তরতাজা হয়ে ধরা দেয়। মাঝে মাঝে চোখের কোনে, ফোকলা দাঁতে, কখনো প্যান খাওয়া, রঙ্গিন ঠোঁটের আড়ালে ঝিলিক দেয় ছোট্ট শিশুর মত হাসি। জীবনের চাওয়া না পাওয়ার বেদনা ধমকে যায় তখন। বেঁচে থাকার গৌরবময় সংগ্রাম আর আত্মপ্রত্যই তখন ত্বরা দেয় তার সুশোভিত বর্ষীয়ান মুখের পরতে পরতে।

চল্লিশের দশকে নোয়াখালীর পুরাতন শহর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেই শহরেরই পাশে ছিলো অজিফা খাতুনের ভিটে বাড়ী। কিছু চাষের জমিও ছিলো। তার স্বামী ফজলুর রহমান তখন পুরাতন শহরে ঘোড়ার গাড়ী চালাতো। সুখেরই দিন যাচ্ছিলো তাদের। নতুন জীবনে তাদের আশা ছিলো একটি ফুট ফুটে শিশুর। হাসি আনন্দে ভরে উঠবে উঠান বাড়ী ঘর। কিন্তু সে আশাগুলো নিরাশাই রয়ে গেলো। শঞর ভাঙ্গার আগেই তাদের বসত বাড়ী নদী গর্ভে বিলীণ হয়ে যায়। ভূমিহীন নিরাশ্রয় হয়ে পড়লো তারা। ঝুপড়ি ঝোপে ভাসমান লতাগুল্মের মত এখানে ভেসে চল্লো তারা। এরই মধ্যে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হলো তার স্বামী ফজলুর রহমানের। অজিফা খাতুনের চোখে মুখে নেমে আসলো অন্ধকার। জীবনের শেষ অবলম্বনও হারিয়ে গেলো চিরতরে। এভাবে জীবনের মধ্য সারহ্নে এসে পৌঁছলেন তিনি। স্বামীর সামান্য সঞ্চয় ছিলো তাও শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু মুষড়ে পড়লেন না অজিফা খাতুন।
পঞ্চাশের দশক থেকে ধীরে ধীরে আবার নদী গর্ভে থেকে জেগে উঠতে লাগলো পুরাতন শহরের জমিগুলো। অজিফা খাতুনও ফিরে পেতে চাইলেন তার জমি জিরাত। লাঠিয়াল ভূমি গ্রাসীদের দৌরাত্মে সে জমির কাছেই ঘেঁষতে পারছিলেন না। শেষে এলাকার এক গন্যমান্য জনের সহযোগীতায় ফিরে পেলেন সে জমি। ফিরে পাওয়া সে জমিকে ঘিরে শুরু হলো অজিফা খাতুনের নতুন জীবন। পায়ের রূপালী খাড়ু চুমকী চুড়ি ফেলে হাতে তুলে নিলেন তিনি কাস্তে কোদাল। পুরুষ শ্রমিকের সাথে জল কাদায় নিজেই চাষাবাদে নেমে পড়লেন। এখন তিনি রীতিমত চাষী। ধর্মাশ্রয়ী সমাজের কটাক্ষকে উপেক্ষা করে মাটির সঙ্গে জীবনের নাড়ীর সখ্যতা গড়ে তুললেন। খড় বিছুলী দিয়ে তৈরী হলো মাথা গুঁজার ঠাঁই। কঠিন শ্রম শেষে সোনালী ফসল উঠে অফিজা খাতুনের ঘরে। অক্লান্ত পরিশ্রম করার ফলে ধীরে ধীরে বার্ধ্যক্যের ছাপ পড়ে তার শরীরে। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠে। তার উত্তরসূরীতো কেউ নেই। মহা ভাবনায় পড়েন তিনি। ইতিমধ্যে লোকে তাকে ‘বুড়ি’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করলো। বয়সতো আর ছাপিয়ে রাখা যায় না। তার স্বামী ঘোড়ার গাড়ী চালাতো বলে আবার বুড়ির নাম উঠে ‘ঘোড়া বুড়ি’। তবে এ নামে তিনি খুশিই হন। স্বামীর কর্মের ছাপ লেগে আছে তার নামের স্ঙ্গেও। স্বামীর গৌরবে গৌরবান্বিতই হন তিনি। নতুন নাম ঘোড়া বুড়ির মাঝে খুঁজে পান স্বামীর স্পর্শ্ব। তবুও জীবনের বিশাল অংশ জুড়ে রয়ে গেছে শুন্যতা। বুড়ি যে নিঃসন্তান। এক সময় তীব্র মাতৃস্নেহের আকাঙ্খা জেগে উঠে বুড়ির বুকে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, একটি শিশুকে দত্তক নিতে হবে। যে হবে তার এই জীবন ও সামান্য সম্পদের উত্তরসূরী। ঘোড়া বুড়ি খুঁজতে থাকে একটি পালা ছেলে। নোয়াখালীর স্থানীয় ভাষায় এই পালক প্রথাকে বলা হয় ‘হুইন্না’। এরই মধ্যে একটি সদ্যজাত ছেলে শিশুকে পাওয়া গেলো ‘হুইন্না’ নেয়ার জন্য। বুড়ি এই শিশুকে সাব্যস- করে লালণ পালণের জন্য। বুড়ি এই শিশুকে সাব্যস- করে লালন পালনের জন্য। ছেলেকে তার কাছেই নিয়ে আসে। বড় করতে থাকে আপন স্নেহে। কিছুদিন যাবার পর ছেলের মধ্যে কিছুটা শারীরিক গোলমান দেখা দেয়। একটু বড় হতেই দেখা গেলো ছেলেটা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। হাবাগোবা। অস্বাভাবিক। বুড়িকে সবাই বুদ্ধি দিতে লাগলো ‘এ ছেলে দ্বারা কোন কাজ হবে না। ওকে ফেলে দাও। আরেকটি দত্তক নাও তুমি। এটিতো আর তোমার পেটের সন্তান নয় যে, এটিকে তোমার কাছেই রাখতে হবে।’ মানুষজনের কথা শুনে বুড়ির স্নেহময়ী হৃদয় কেঁদে উঠলো। হু হু করে উঠে তার বুক। ‘একি বলছে মানুষেরা। পৃথিবীতে মায়া, মমতা, নাড়ীর টান বলে কি কিছুই নেই। বিবেক আর মানবিকতার প্রত্যয়ে বুড়ি সবাইকে জানিয়ে দেন, ‘এটি যদি আমার পেটের সন্তান হতো তাহলে কি আমি এই শিশুকে ফেলে দিতে পারতাম? আপন শিশু শত বিকলাঙ্গ হলেও মা কি তাকে ছুঁড়ে দিতে পারে? এযে আমার নাড়ী ছেঁড়া সন্তান’। ঘোড়া বুড়ির মহা-মানবতার কাছে মাথানত করলো সবাই। এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো বুড়ির মহানুভবতার কথা। গ্রামের সকল মানুষ, ঘোড়া বুড়ির প্রতি শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় মাথা অবনত করলো।

মানুষ যখন স্বার্থ দ্বন্দ সংঘাত আর না পাওয়ার বেদনায় অসি'র হয়ে উঠছে তখন নোয়াখালীর প্রত্যন্ত চরের এই জল কাদা নোনা মুখের এক অতি সাধারন নারী চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিলেন এক মানবিকতার দিক চিহ্ন। সে সাথে বুড়িও সাজিয়ে নিয়েছে তার অসাধারন মানবিক জীবন। বুড়ি পরম স্নেহ মমতায় বুকে তুলে নেন সেই শিশুকে। নাম রাখেন ‘ফরাজি’। স্নেহ মমতায় বড় হতে থাকে ছেলে। মাঝে মধ্যে বুড়ির সাথে কাজে নেমে পড়ে সে। ছেলে লায়েক হলে দেখে শুনে একটি বৌ- ঘরে আনেন বুড়ি। লক্ষ্মী বৌ। ছেলে হাবাগোবা হলেও বৌটি বেশ কাজের। বুড়ির একা গড়া সংসার কাঁধে তুলে নেয় সে বৌ। গুছিয়ে গাছিয়ে রাখে সংসার। বুড়ির এখন সাত সাতটি নাত নাতনী। দাদীর আঁচলের ছায়ায় খুঁজে পায় স্বর্গসুখ। উচ্ছল শিশুরা হাসি আনন্দে মাতিয়ে রাখে বুড়িকে। ছেলে ফরাজি দিন মজুরী করে। চাষাবাদও করে মাঝে মাঝে। বুড়ির প্রতি নির্ভরশীল সে। কোন দিন কাজ করে কোন দিন করে না। মা ছাড়া পৃথিবীতে যেন তার আর কেউ নেই। কেউ বুঝতে পারে না ফরাজি বুড়ির পালক ছেলে। ‘হুইন্না’ আনা ছেলে।

মায়া মমতা স্নেহ বন্ধনহীন মুৎসুদ্দী সমাজ থেকে অনেক দূরে নিভৃত চর সল্লায় এক মমতাময়ী মানবী প্রকৃতির এক আপন নিলয়ে সৃষ্টি করলো অসাধারন এক মানবিক কাহিনী। সে কাহিনীর পত্র পল্লবে বাজে মানবিকতার সুর। বুড়ি হিসেব করে জানালেন তার বয়স এখন প্রায় একশ’ বছর। এ বয়সেও কর্ম চঞ্চলতা কমে নি বুড়ির। লাঠি ভর দিয়ে বাড়ী থেকে চার কিলোমিটার দুরে সোনাপুর বাজারে প্রায় হেঁটে আসেন বুড়ি। বার্ধক্যের অবসাদ মাঝে মাঝে ঘিরে ধরে তাঁকে। কখনো স্মৃতি হাতড়ে খুঁজেন অতীত।
বুড়ি দেখেছেন নোয়াখালীর পুরাতন শহরের প্রাণ চঞ্চলতা। দেখেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোরা সৈন্যদের। দেখেছেন নোয়াখালী শহরের ভাঙ্গা গড়ার খেলা। দেখেছেন ঝড় বন্যা জলোচ্ছাস। কাটিয়েছেন অভাব আর দুর্ভিক্ষের দিনগুলি। তার শরীরের চামড়া গুলো এখন থলথলে হয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ আর কপালে সরু সরু রেখা। চাত্তুর উদাস চোখে মাঝে মাঝে তাকায় পিছনে অনেক দূরের পিছনে। অসাই ধোঁয়ার আচ্ছাদনে সেখানে পড়ে আছে প্রথম জীবনের অনেক সুখ কর স্মৃতি।
পরের সন্তানকে আপন হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন শত বর্ষের অজিফা খাতুন। কোন স্বার্থ বা পাওয়ার লোভে নয়। এ শুধু এক মমতা ময়ী মায়ের স্নেহের এক নিখাদ স্পর্শের কাতরতা। এ স্নেহকে এ মমতাকে পৃথিবীর কোন মান দন্ডে ঝুলানো যায় না। শুধু শুদ্ধতম হৃদয় আর অনুভূতির শিহরন দিয়ে তাকে অনুভব করা যায়।

এই ঘাত প্রতিঘাতের পৃথিবীতে কেন মানুষ মানুষের জন্য হতে পারে না! বাংলাদেশের গ্রামের নারীদের বুদ্ধি কর্ম আর মানবিকতার হিসাব কেউ করে না। কত মানবিকতা কত স্নেহার্ত হৃদয় অবগুন্ঠনে ঢাকা পড়ে আছে। জীবন সংগ্রামী কত নারী কত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে গৌরবময়ী করে তুলেছে। নোয়াখালীর চর সল্লার অজিফা খাতুন সেই মিছিলেরই এক অসাধারন নারী।
লোভ স্বার্থ আর অমানবিকতার পৃথিবীতে আমরা সভ্যতার দাবীদার মানুষেরা ক’জন এই নিভৃতচারী অজিফা খাতুনদের খবর রাখি!


লোকসংবাদ

No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.