Scrollwhite

মাহমুদুল হক ফয়েজ My name is Mahmudul Huq Foez, I am a journalist, leaving in a small town, named Noakhali , which is situated in coastalzila of Bangladesh

হোমপেইজ | আর্টিকেল | ছোটগল্প | ফিচার | মুক্তিযুদ্ধ | বনৌষধি | সুস্বাস্থ্য | কবিতা | যোগাযোগ

শহীদ ভুলুর রক্তঝরা স্মৃতি

শহীদ ভুলুর রক্তঝরা স্মৃতি
মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ


নোয়াখালীতে যার নামে শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম
এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা
শহীদ সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু


বৃহত্তর নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবউদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু একাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর হানাদার পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাপূর্ব নোয়াখালীর গৌরবময় ক্রীড়া জগতের অন্যতম সংগঠক। এক সময় বৃহত্তর নোয়াখালীতে কচি, ছালু ও ভুলু এই তিন ভাইয়ের নাম ফুটবল সহ ক্রীড়াঙ্গনে ছিলো সুপরিচিত। তাঁদের ফুটবল দলের নাম ছিল এস্কেন্দার ব্রাদার্স। তাঁর পিতা মরহুম সেকান্দার মিয়া ছিলেন নোয়াখালীর স্বনামধন্য উকিল, জেলা উকিল বারের সভাপতি ও বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। শহীদ ভুলুর বড় ভাই মরহুম সাহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার কচি মিয়া ছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের সময় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠানিক সম্পাদক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও নোয়াখালী পৌর সভার সাবেক চেয়ারম্যান। সাবেক এম,এন,এ ও এম,পি।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নোয়াখালী টাউন হল ছিলো মুক্তিযুদ্ধের কন্ট্রোল রুম। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রন করা হতো। শহীদ সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব পেয়ে টাউন হলেই তাঁর কর্মতৎপরতা শুরু করেন। এপ্রিলের শেষে পাক হানাদার বাহিনী এ শহর দখল করলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দিকে মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। তখন শহীদ ভুলু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শহরের পূর্বাঞ্চলে কাদিরপুরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি গড়ে তুলেন। তিনি ২ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দারের অধীনে ছিলেন। সে সময় কাদিরপুরে তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির কাছে ডা:রজনী কুমার দাসের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হতো। উত্তর কাদিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি । ৫ সেপ্টেম্বর সেই ঘাঁটির উপর দিয়ে একটি পাকিস্তানী ফাইটার বিমান খুব নীচু হয়ে উড়ে যায়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা বিমান লক্ষ করে মেশিন গান থেকে গুলি ছুঁড়ে। এদিকে স্থানীয় রাজাকাররা গোপনে মুক্তিযুদ্ধর ঘাঁটির সঠিক খবরাখবর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে জানায়। আগরতলার এক তরুণ নবীন ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। তাঁর নাম ছিলো অমল নাগ। তিনি ক্যাপ্টেন নাগ বলে সমধিক পরিচিত ছিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে পার্শবর্তী বসুর হাটে মুক্তিযোদ্ধাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে শহীদ ভুলু ও ক্যপ্টেন নাগ অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে গভীর রাতে কাদিরপুর ক্যাম্পে ফিরে আসেন। সেই ক্যম্পের পাশে খালের মধ্যে নৌকা বেঁধে তাঁরা নৌকার মধ্যেই ঘুমিয়ে ছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর খুব প্রত্যুশে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুলের পাক বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছয়টি নৌকা বোঝাই এক প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য অতর্কিতে এসে সমগ্র এলাকা ঘিরে ফেলে। আকস্ম্যাত ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধারা হতচকিত হয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারলেও সে সময় শহীদ ভুলু ও ক্যাপ্টেন নাগ গভীর ঘুমের মধ্যে ছিলেন। ত্বরিৎ বেগে হানাদার পাক সৈন্যরা তাঁদের নৌকা ঘিরে ফেলে। ঘুম থেকে জেগে উঠেই তাঁরা পাক সৈন্যদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাক সৈন্যদের একটি গুলি সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলুর বাম বাহুতে এসে লাগলে তিনি মারাত্মক আহত হন। আহত অবস্থায় তিনি ও ক্যাপ্টেন নাগ পাক সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যান। হানাদাররা তাঁদেরকে পার্শবর্তী স্কুলের বারান্দায় এনে হাত পিছমোড়া করে গরুর রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। পাক সেনারা বারবার জানতে চায়, কে সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু। তখন সেখানে উপস্থিত দুই ঘৃন্য রাজাকার কাজী অবুবকর সিদ্দিক ও কাজী মতিউর রহমান শহীদ ভুলুকে দেখিয়ে দেয়। তখন তারা উভয়কে বেগমগঞ্জ আর্ম ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাজাকাররা তাঁদের দুজনকে এখানেই হত্যা করতে পিড়াপিড়ি করে। এ নিয়ে রাজাকার ও হানাদার বহিনীর অফিসারের সাথে উত্তপ্ত বাক্যও বিনিময় হয়। তখন শহীদ ভুলু বার বার জয় বাংলা বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় পাক সৈন্যরা বেয়নেট দিয়ে তাঁর কণ্ঠনালী কেটে ফেলে। এরপর তাঁকে পিছন দিক থেকে পরপর তিনটি গুলি করে। মৃত্যু নিশ্চিত হতে হায়নারা তাঁকে বেয়োনেট দিয়ে বার বার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে। সে অবস্থায় তাঁর লাশ সেখানে পড়ে থাকে। শহীদ ভুলুর লাশ সেখানে ফেলে রেখেই পাক বাহিনীরা ক্যাপ্টেন নাগকে নিয়ে বেগমগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরে যায়। ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন নাগের উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। দেশ স্বাধীন হলে অর্ধমৃত অবস্থায় তিনি মুক্তি পান।

হানাদার বহিনীরা কাদির পুর ছেড়ে চলে গেলে মুক্তি বাহিনীরা এসে শহীদ ভুলুর লাশ উদ্ধার করে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁর বাড়িতে এনে তাঁর বাবার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করে। এর কয়দিন পর সেনবাগে রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক যুদ্ধে কজন রাজাকার সহ শহীদ ভুলুর হত্যার সহযোগি দুই রাজাকার কাজী আবু বকর সিদ্দিক ও কাজী মতিউর রহমান মারা পড়ে।

সাহাব উদ্দিন ভুলু শহীদ হওয়ার সময় তাঁর তিন ছেলে ছিলো একেবারেই শিশু। তখন বড় ছেলে জুয়েল চার বছর, মেঝো ছেলে সোহেল আড়াই বছর ও ছোট ছেলে দীপেলের বয়স ছিলো মাত্র ছয়মাস। তাদের মাইজদী শহরের লক্ষীণারায়ন পুরের বাড়িটি ছিলো রাজনীতির নানান স্মৃতিতে ঘেরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাষানী, সোহরাওয়ার্দী, পাকিস্তানের বিরোদীদলের নেতা আজম খাঁন প্রমুখ দেশ বরেণ্য নেতাদের পদচারনায় এলাকাটি ছিলো সদা মুখরিত। সে স্মৃতিময় বাড়িটিও পাক হানাদারেরা পুড়িয়ে দেয়। সেই থেকে নানান ঘাত প্রতিঘাতে আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শীদের সহযোগীতায় তারা আজ মানুষ হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নোয়াখালীতে এসে শহীদ ভুলুর বৃদ্ধা মা ‘আজমুদা খাতুন’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, আপনার এক ছেলে যুদ্ধে হারিয়ে গেলেও আমিতো আপনার আর এক ছেলে আছি। পঁচাত্তর পরবর্তীতে এই পরিবারের উপর সরকারি ভাবে নেমে এসেছিলো বঞ্চনা আর অবহেলা। সবচেয়ে আশ্চর্য ও গ্লানিকর দিক হলো, যে দুই রাজাকার শহীদ ভুলকে হত্যার সহযোগীতা করেছিলো কাজী আবু বকর সিদ্দিক ও কাজী মতিউর রহমান দুজনেই একসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অত্যন্ত ঘৃনিত ভাবে মৃত্যু বরণ করলেও দীর্ঘদিন থেকে শহীদ পরিবার হিসাবে তাদের পোষ্যরা ভাতা পেয়ে আসছিলো।স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের নামে এ বরাদ্ধ এতো দিন দিয়ে আসছিলো বলে শহীদ ভুলু পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

নোয়াখালীর ক্রীড়া জগতের এক সময়ের এ অনন্য সংগঠকের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর মহান অবদান ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জেলাবাসি এ এলাকার একমাত্র ষ্টেডিয়ামের নাম করণ করে,শহীদ ভুলু ষ্টেডিয়াম। এটি এখন আন্তর্জাতিক মানের ষ্টেডিয়াম হিসাবে গড়ে উঠছে।

নোয়াখালীবাসি এই অকুতভয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।


দৈনিক ডেস্টিনি


No comments:

Post a Comment

About Me

My photo
Mahmudul Huq Foez Free-lance journalist, Researcher.