উপকূলের চিংড়ি পোনা
মাহমুদুল হক ফয়েজ
নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পোনা। এই চিংড়ি পোনা ধরার জন্য গড়ে উঠেছে একটি জেলে সম্প্রদায়। প্রায় বার থেকে পনের হাজার জেলে এই পোনা ধরার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সাধারনতঃ বর্ষা মৌসুমেই সবচেয়ে বেশী পোনা ধরা পড়ে। বাগদা ও গলদা উভয় চিংড়ি এখানে পাওয়া যায়। সুধারামের দক্ষিন পশ্চিমে ভুলুয়া নদীর মোহনা থেকে পূর্বে চরলক্ষীর মুহুরি নদীর মোহনা পর্যন্ত এই বিশাল এলাকাতেই এখন সবচেয়ে বেশী পোনা পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন সমুদ্রের জোয়ারের সঙ্গে ভেসে আসে প্রচুর পোনা, সেই সময় শত শত জেলে ছোট ছোট এক বিশেষ ধরনের অত্যন্ত সুক্ষ জাল নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। অনেকে আবার অসংখ্য নৌকায় বাঁশ বেঁধে জালগুলো স্রোতের মুখে মেলে ধরে। এ অবস্থায় জালে প্রচুর ছোট আকৃতির পোনা ধরা পড়ে। জেলেরা সেগুলো বড় বালতি বা গামছায় পানিসহ এনে নদীর পাড়ে বাছাই করে। অনেক পোনা এত ছোট যে খালি চোখে দেখতেও খুব কষ্ট হয়। এই পোনাগুলোকে ঝিনুকের খোল দিয়ে একটি একটি করে গুনে গুনে ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে জমা করা হয়। এভাবে একেক জন প্রতিদিন এক দেড়শত পোনা ধরতে পারে। সময় ভেদে এই পোনা দুইশ্’ থেকে পাঁচশ’ টাকা প্রতি শ’ বিক্রি হয়। এদের কাছ থেকে পোনা কেনার জন্য যশোর ও খুলনা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ভীড় করে। নোয়াখালী শহর থেকে চর মজিদ ঘাট পর্যন্ত প্রসস্ত পাকা রাস্তা হয়ে যাওয়াতে পরিবহনেও অনেক সুবিধা হয়েছে।
ফড়িয়াদের আনাগোনা
এ ব্যবসা দিনদিন প্রসারিত হওয়াতে এখানে একে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এক ফড়িয়া সম্প্রদায়।তারা বিভিন্ন চিংড়ি ঘের মালিকদের পক্ষে এসে জেলেদের কাছে জাল ও অন্যান্ন সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। বিনিময়ে তারা জেলেদের ধরা সমস্ত পোনা নাম মাত্র মূল্যে নিয়ে যায়। মোঃ শফিক(৩৫) ও ছানাউল্লাহ (৪৫) গত দুই বছর ধরে এখানে পোনা ধরছে। শফিকের সঙ্গে থাকে তার দুই ছোট ছেলে। তারা তাকে পোনা বাছাই করতে সাহায্য করে।ছানাউল্লা ও শফিক জানাল, প্রতি কাটালে ( প্রতি পনের দিন ) বয়ার চরের পাশের নদিতে পোনা ধরার জন্য মাস্তানদের পাঁচশ’ টাকা করে দিতে হয়। তার উপর ফড়িয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে তাদের পোনা অবিক্রিত থেকে যায়। তখন সারাদিনের শ্রমও বিফলে যায়। প্রতি মৌসুমে এই এলাকায় গড়ে উঠে চিংড়ি পোনার বিশাল আড়ত। এই আড়তে লেনদেন হয় লক্ষ লক্ষ টাকার পোনা। বড় বড় ড্রামে অক্সিজেনের বিশেষ ব্যবস্থাধীনে সেগুলোকে পরিবহনের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। পরে ব্যবসায়িরা খুলনা থেকে এসে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায় সেই সব পোনাগুলো। সেই অঞ্চলের চিংড়িঘের মালিকদের কাছে এই পোনাগুলোর বেশ চাহিদা রয়েছে।
ভিন্ন মাছের পোনা নিধন
বিস্তীর্ণ এই উপকুলে শুধু চিংড়ি পোনাই পাওয়া যায়না সামুদ্রিক জোয়ারে এখানে ভেসে আসে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির লক্ষ লক্ষ কোটি মাছের ডিম আর পোনা। সুক্ষ চিংড়ি জালে সেই সব ডিম ও পোনা গুলো আটকে যায়। ফলে ধ্বংস হছে প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত অফুরান সেই সব রূপালী সম্পদ। এই এলাকার অনেক প্রবীণ জেলে জানিয়েছেন, উপকূলের কাছাকাছি এই সমদ্রে এখন আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করছেন চিংড়ি পোনা ধরার সাথে এই সব সম্ভাবনাময় মাছগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সাগর পাড়ের এক মাঝি রশিদ মিয়া জানান, নগদ দুই টাকার লোভে দশ টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চিংড়ি সহ অন্যান্য সমুদ্রে বেড়ে উঠলে সমুদ্র থেকেই সেগুলো বড় আকারে ধরা যেতো। উপকৃত হতো হাজার হাজার নিম্ন আয়ের জেলেরা। এই পোনা ধরার জন্য অবশ্যই একটি নীতি থাকা উচিৎ।
আমাদের আছে অফুরন্ত মানব সম্পদ। আছে উপকূল জুড়ে সম্পদের হাতছানি। রয়েছে মৎস্য সম্পদের বিশাল ভান্ডার। পরিকল্পনা ও সুষ্ঠ নীতি দিয়ে আমরা গড়ে তুলতে পারি শক্ত মজবুত অর্থনীতি। গুটিকয়েক সার্থন্ব্বেষী লোভী মানুষের জন্য দেশের সম্পদ নষ্ট নয়। এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে যেন আপামর জনসাধারণ দেশের সম্পদ গুলো সমান ভাবে ভোগ করতে পারে। উপকূলের সম্পদ গুলো ধ্বংস নয়, সংরক্ষণ আজ বড় বেশী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
লোকসংবাদ
১ আগষ্ট, ১৯৯৮
No comments:
Post a Comment