ভাষা শহীদ আবদুস সালাম
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
একুশে ফেব্রুয়ারী এখন শুধু দিবস উদযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। একুশ আমাদের গৌরবের, অর্জনের, অহংকারের। একুশ এখন বিশ্ব সভায় স্বীকৃত মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি এখন থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে পালিত হবে।
মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক সালাম বরকত। যাঁদের আত্মত্যাগে এ দিনটি আজ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত, সম্মানিত ও স্বীকৃত হয়েছে সে সব শহীদদের পরিবার পরিজনদের খবর কতটা জানে দেশ বাসী। তাঁদের জন্মস্থান, পড়াশুনা, বেড়ে উঠা এসব খবরাখবর জানার আগ্রহ জাগে অনেকের। তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনরা কে কেথায় আছেন কেমন আছেন এ দিনটি নিয়ে তাঁরা কি ভাবছেন। কি তাদের আকাঙ্খা এ সব জানার কৌতুহল আছে অনেকের মধ্যেই।
এ সব বিষয় জানার জন্য সরেজমিন গিয়েছিলাম সালামের পৈত্রিক নিবাস বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী জেলার দাগনভূঞা থানার লক্ষণপুর গ্রামে।
ফেনী চৌমুহনী সড়কের পাশে ফেনী থেকে তের কিলোমিটার পশ্চিমে ও চৌমুহনী থেকে চব্বিশ কিলোমিটার পূর্বে বেকের বাজার নামে একটি বাজার রয়েছে। সে বাজারের পাশেই শহীদ সালামের পৈত্রিক নিবাস লক্ষণপুর গ্রাম। বাংলাদেশের অতিসাধারন একটি শান্ত স্নিগ্ধ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গেছে ফেনী নদীর একটি শাখা মাতুভূঞা খাল। মাতুভূঞা পোলের পাশ দিয়ে উত্তরে পাকা সড়ক থেকে একটি মাটির রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভিতর। সে রাস্তার মুখে প্রধান সড়কের পাশে কাঁচা হাতের লেখা একটি সাইন বোর্ডে লেখা আছে ‘সালাম নগর’ । সে সাইনবোর্ডেরই এক কোনে আঁকা আছে একটি শহীদ মিনার। এই সালাম নগর বা লক্ষণপুর গ্রামই শহীদ সালামের জন্ম স্থান। কাঁচা রাস্তার দু’একটি বাঁক পার হলেই চোখে পড়ে ‘লক্ষণপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। স্কুলের সামনে একই হাতে সাইনবোর্ডে লেখা ‘শহীদ সালাম প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সে স্কুলের পশ্চিমে ধানক্ষেত পেরিয়ে দু’টি বাড়ী পিছনে ফেলে গেলেই সালামের পৈত্রিক বাড়ী। গ্রামের আর দশটা বাড়ীর মত সাধারন গৃহস্থ বাড়ী। গ্রামের পথচারীদের শহীদ সালামের বাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করতেই চিনিয়ে দিলো। বাবা মোঃ ফাজিল মিয়া ছিলেন একজন কৃষক। সামান্য পড়ালেখা জানতেন তিনি। পিতা মোঃ ফাজিল মিয়া ১৯৭৬ ইং সনে মারা যান। তাঁর মা দৌলতের নেছা মারা যান ১৯৮২ ইং সনে।
শহীদ সালামের বর্তমান দু’ভাই ও একবোন জীবিত আছেন। এ বাড়ীতে শহীদ সালামের দু’ভাই থাকেন। তারা ছিলেন সবার বড়। এরপর আবদুস সোবহান (৭২) একজন কৃষক। তিনি সামান্য পড়ালেখা জানেন। অপরভাই আবদুল করিম (৪৮) সেনাবাহিনীতে চাকুরী করতেন।’ ৬৮সনে এস.এস.সি পাশ করার পর সেনাবাহিনীতে সিপাহী হিসাবে চাকুরী নেন এবং সুবেদার হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। দুই বোনের মধ্যে বড় কুরফুলের নেছা গত বছর মারা গেছেন। তার স্বামী শরাফত আলী চায়ের দোকান করতেন, তিনিও মারা গেছেন। আর এক বোন বলকিরতের নেছা। তাঁর স্বামী ছানু মিয়া ক’বছর আগে মারা গেছেন। ছোট খাট একটি চাকরী করতেন তিনি। বোনেরা কেউ তেমন পড়ালেখা করে নি। পরিবারের অন্য কেউই তেমন পড়া লেখা করে নি। পরিবারের দু’জন মাত্র এস.এস.সি পাশ করেছেন একজন ভাই আবদুল করিম (৪৮) অপরজন ভাগিনা। বলকিয়তের নেছার ছেলে মোহাম্মদ উল্ল্যাহ। শহীদ সালাম স্থানীয় কৃষ্ণরামপুর প্রাথমিক স্কুলে পড়ালেখা করে পরে ঢাকার কোনো স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। কিন্তু কেউ বলতে পারে নি ঢাকার কোন স্কুল থেকে ম্যাট্টিক পাশ করে ছিলেন। ম্যাট্টিক পাশের পর তিনি ঢাকায় ডাইরেক্টর অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি অফিসে চাকুরী নেন। বায়ান্ন’র ২১ ফ্রেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে মিছিলে তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন। গুলিতে সালামের আহত হবার সংবাদ তাঁর বাবা বাড়ীতে পেয়েছিলেন শহীদ সালামের এক জ্যাঠাতো ভাই মোঃ হাবিব উল্ল্যাহর কাছ থেকে। সাথে সাথে ঢাকা থেকে টেলিগ্রামেও খবর আসে। খবর পাওয়ার পর তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সালামকে দেখতে যান। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ই ফেব্রুয়ারী সালাম মারা যান। পরে তাঁর মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ সালামের ভাই আবদুস সোবহান (৭২) এখন বার্ধ্যক্য অবস্থায় ন্যূজ হয়ে পড়েছেন। চোখে পুরো চশমা। তাঁর ঘরে বসে আবদুল করিম (৪৮) সহ তাঁরা ঘরে বসে আবদুল করিম (৪৮) সহ তাঁরা দু’ভাই কথা বলছিলেন। সাধারন টিনের মাটির ভিটি ঘর। বেড়া দিয়ে ঘরের কামরা করা হয়েছে। কামরার ভিতর দরজায় কোন কপাট নেই। সেখানে একটি পর্দ্দা দেয়া আছে। কোন অতিথি এলে এখানেই বসানো হয়। এ কামরায়া একটি শোয়ার চৌকি এবং দুটি কাঁচের শো-কেইস্ রয়েছে। তার মধ্যে আছে কিছু কাঁচের তৈজস পত্র। উপরে টাঙ্গানো রয়েছে কয়টি ছবি। একটি শহীদ মিনার ও একটি জাতীয় স্মৃতি সৌধের ছবিও আছে। কাঁচা হাতে আঁকা সে ছবি দুটি বাঁধানো রয়েছে। ছবির নীচে লেখা রয়েছে ‘ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে শহীদ মিনার’ অপরটিতে লেখা ‘শহীদ মোঃ আবদুস সালাম’। গ্রামের সাধারন মানুষ একুশের চেতনা সমন্ধে খুব সচেতন নয়। অনেকেই জানে না সালাম কি ভাবে শহীদ হলেন। বেকের বাজারে মমিনের চায়ের দোকানের ছেরাজল হকের পুত্র রহিম (২৫) সঠিক ভাবে জানে না সালাম কি ভাবে শহীদ হলেন। সে কোনদিন আগ্রহ ভরে শহীদ সালামের বাড়ী যায় নি। তবে এ টুকু জানে তিনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। শহীদ সালামের সামনের বাড়ীল আবদুল মোতালেবের পুত্র বাবুল (২০) জানে না একুশের আত্মত্যাগের কথা। সে বলে ‘আমি ক্যামত কমু, আমিতো তখনও হই নাই। হুনছি মিলিটারীর ভাই ঢাকায় গুলি খাই মারা গেছে’। শহীদ সালামের ভাই আবদুল করিমকে গ্রামের সবাই মিলিটারী বলেই জানে।
শহীদ সালামের পরিবারের কেউই তেমন বেশী পড়ালেখা করে নি। প্রাইমারী পাশের আগে অনেক মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা এস.এস.সি পাশের আগেই নানা পেশা ও কাজে লেগে গেছে। ভাই আবদুস সোবহান গ্রামের স্কুলে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন। তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে মন্নান (৩৫), ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ে এখন গাড়ীর ড্রাইভার, মেঝো ছেলে নূর আলম (২৮), ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ার পর ড্রাইভরী করেন। ছোট ছেলে ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ে কাপড়ের ব্যবসা করেন। দু’ মেয়ের বড় মেয়ে হোসনে আরা ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন, স্বামী মৃত সহিদ আলম চায়ের দোকান করতেন। ছোট মেয়ে রেহানা আক্তার (২২) ৬ষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন। স্বামী নূরুল হক বিদেশে ছিলেন সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন।
শহীদ সালামের ছোট ভাই আবদুল করিম (৪৮) ৬৮ ইং সনে এস.এস.সি পাশ করেছেন। তার এক ছেলে, চার মেয়ে। বড় মেয়ে দিলরুবা করিমুন নেছা (১৮) ৮ম শ্রেনীতে, খালেদা আক্তার (১২) ৬ষ্ঠ শ্রেনী, খদিজা বেগম (১১) ৬ষ্ঠ শ্রেনী, হালিমা খাতুন (১০) ৪র্থ শ্রেনীতে পড়ে। আবদুল করিম জানান তার ছেলে মেয়েদের তিনি যতদূর সম্ভব পড়ালেখা করাবেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ সালাম আত্মহুতি দিলেও এ পরিবার কিংবা এই গ্রামবাসীর উপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। তারা এটিকে একটি দুর্ঘটনা হিসাবেই দেখে এসেছে। তাঁদের পিতা অবশ্য প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকা কিংবা ফেনীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। রাষ্ট্রীয় সামাজিক বা রাজনৈতিক ভাবে কেউ কোনদিন কোন খোঁজ খবর নেয় নি। কোন চিঠি পত্রও দেয় নি কেউ। গত দু’তিন বছর এ নিয়ে সরকারী ভাবে উদ্যোগ নিলে তাঁদের কাছে অনেকে আসছেন। খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এখন তাদের মধ্যেও কিছুটা আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। ফেনীর জননেতা প্রয়াত এম.পি খাজা আহম্মেদ সালামের একমাত্র ছবিটি নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন তাঁদের কাছে সালামের আর কোন ছবি নেই। দাগনভূঞা থানা থেকে গ্রামের নাম ‘ভাষা শহীদ সালাম নগর’ করার জন্য প্রস্তাব হয়। একটি নাম ফলক দেয়া হয় গ্রামের প্রবেশ মুখে। ফেনীর সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী এসেছিলেন সালামের বাড়ী। তিনি এ গ্রামে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কথা বলে গেছেন। লক্ষণপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম ভাষা শহীদ সালামের নামে করার জন্য প্রস্তাব জানানো হয়। সে সব কিছু এখনো কার্যকর হয় নি।
ফেনী জেলার দাগনভূঞা থানার ৭নং মাতুভূঞা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ছোট্ট এ গ্রাম লক্ষণপুর। গ্রামের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪শ’। গ্রামের প্রায় ৩০ শতাংশ লোক শিক্ষিত। এখন অবশ্য শিশু শিক্ষার হার বাড়ছে। ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান বধির এবং ওয়ার্ড মেম্বার এবাদল হক। সালামের পরিবার থেকে বলা হয়েছে এরা তাদের খোঁজ খবর রাখেন। শহীদ সালামের বাবার ছিলো এক কানি বা এক একর বিশ ডিসিমিল সমপরিমান কৃষি জমি। মূলতঃ সেই জমিই ছিলো তাদের আয়ের উৎস। এখনও সেই সমপরিমান জমিই আছে তাঁদের। ভাই আবদুল করিম সেনা বাহিনী থেকে অবসর নেয়ার সময় কিছু টাকা পেয়েছেন। এখন পেনশন পাচ্ছেন। কোন সম্মান জনক বেসরকারী চাকরী পেলে করার ইচ্ছা আছে। সরকারী কোন অনুদান সাহায্য বা সুযোগ সুবিধা এ পরিবার কখনো নেয় নি বা কেউ দেয়ও নি। কারো কাছে কোনদিন কিছু চানও নি। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এ পরিবারের একটি ছেলে ভাষার জন্য দেশের জন্য আত্মহুতি দিয়েছে এটাই এখন তাদের বড় তৃপ্তি। সালামের জন্য আজ সারা বিশ্বে দেশের গৌরব বেড়েছে। এর চেয়ে বেশী তাদের নিজেদের জন্য চাওয়া পাওয়ারও কিছু নেই। তবে একটি আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন শহীদ সালামের পরিবার। সালামের স্মৃতিকে এ গ্রামে ধরে রাখার জন্য লক্ষণপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে শহীদ সালাম প্রাথমিক বিদ্যালয় করা’ লক্ষণপুর গ্রামকে ভাষা শহীদ সালাম নগর নাম করণ করে সরকারী ভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত হওয়া, প্রধান পাকা সড়ক থেকে শহীদ সালামের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তাটি পাকা করা, এই গ্রামে সরকারী উদ্যোগে একটি শহীদ মিনার স্থাপন করা।
বায়ান্ন সনের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙ্গালী জাতি অর্জন করেছে অনেক গৌরব। সে অর্জনের সর্বশেষ সংযোজন একুশ আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ্বসভায় স্বীকৃত। শহীদ সালাম সে গৌরব অর্জনের এক মরণজয়ী অভিযাত্রী। শহীদ সালামের শৈশবে বেড়ে উঠা জনপদ, পত্র পল্লবে ভরা গ্রাম, সোঁদা মাটি জন্মের সেই স্মৃতি চিহ্ন আরো বেশী দৃশ্যমান আরো বেশী গৌরবের হয়ে উঠুক।
বিঃ দ্রঃ শহীদ সালামের পিতা মোঃ ফাজিল মিয়া ৭৬ ইং সনে মারা যান। তাঁর মা দৌলতের নেছা মারা যান ৮২ ইং সনে।
মুক্তকন্ঠ
No comments:
Post a Comment