নীল সাগরের কষ্ট
মাহমুদুল হক ফয়েজ
অনেক বার ভেবেছি নিঝুম দ্বীপ যাব। কিন্তু যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। যারা গেছে তারা এই দ্বীপকে হাতিয়ার দক্ষিনে সাগর থেকে জেগে ওঠা এক রহস্যময় দ্বীপ হিসেবেই জানে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সীমাহীন জলরাশি উপকূলে আছড়ে পড়ার দৃশ্যের কথা কল্পনা করে কার না মন ছুটে যায়।
মাত্র কিছুদিন আগেও এটি ছিল দুর্গম দ্বীপ। এখন নোয়াখালীর মাইজদীকোর্ট থেকে পাকা রাস্তা চলে গেছে চর মজিদ হাতিয়া স্টিমার ঘাটে। সেখান থেকে সরকারী সী ট্রাক অথবা ট্রলারে হাতিয়া হয়ে সহজে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। চর মজিদ থেকে স্পিড বোটে সরাসরিও যাওয়া যায়। বাবার অনুরোধে আমি যখন চট্রগ্রামের খাতুনগঞ্জের জমজমাট ব্যবসা ছেড়ে দেশের বাড়ী নোয়াখালী চলে আসলাম, তখন অসুস্থ বাবার কাছে থাকার মানসেই তার কাছে গ্রামে চলে আসা। দীর্ঘদিনের সাজানো ব্যবসা ছেড়ে আসতে কিছুটা কষ্ট হয়েছিলো বৈকি। কিন্তু মাইজদী এসে পুরানো বন্ধু বান্ধব, আমার শৈশবের গ্রাম লক্ষ্মীনারায়নপুর আর দক্ষিনের চরের আইলে আইলে যতই ঘুরেছি ততই বিমোহিত হয়েছি। উপকুলের প্রতি পদে পদে আর ধুলিকণায় অফুরন্ত সোনালী সম্পদ। একটু খোঁচা দিলেই বেরিয়ে পড়ে রাশি রাশি চক্ চকে সোনা।
বাবা গত হয়েছেন দু’বছর। আম্মা আমাকে ছাড়া অস্থির হয়ে ওঠেন। তাকে কিছুক্ষনের জন্য ঘরে রেখে যেতেও তার কাছে বলে যেতে হয়, আমি কোথায় যাচ্ছি, আবার কখন ফিরবো। আর খুব বলে কয়ে বুঝিয়ে যেতে হয় আমার সন্তানদ্বয় রৌদ্র আর বৃষ্টিকে। বৃষ্টির সাত বছর একটু বুদ্ধি হয়েছে। তবে তিন বছরের রৌদ্রকে বুঝিয়ে বাগে আনতে বেশ কষ্ট হয়। শেষমেষ চকলেটের বায়না নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে হয়। বায়না শুধু তার জন্য নয় তার আপু, দাদু, আম্মু, মাহবুবের জন্যও আনতে হবে। এই কথা ভেবে আমার খুব ভাল লাগে যে, এতটুকু বয়সে সে সবাইকে নিয়ে ভাবছে। কোন দিন যদি শুধু একটি চকলেট নিয়ে আসি তাহলে সামনের নতুন উঠা দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবাইকে দিয়ে থুয়ে তার ভাগটি খুব ছোটই হয়ে যায়। তখন চকলেটের কাগজ জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে বাড়তি স্বাদটুকুও নিয়ে নেয়। আমি এগুলো দেখে খুব উপভোগ করি। সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষে মিলিয়ে যায়। বৃষ্টির ছিল বাতাসার বায়না। এখন অবশ্য বায়না পাল্টিয়ে হয়েছে রং পেন্সিল। প্রায়ই তা হারাবে আর মাহবুবকে খাটের নিচে টেবিলের নিচে ঘরের কোণায় কোণায় হাতড়িয়ে ভাঙাচোরা পেন্সিলগুলো খুঁজে আনতে হয়। মাহবুবও ছবি আঁকে, এগুলো তার ভান্ডে জমা হয়ে যায়। সে খুব যত্ন করে এগুলো তার কাছে রেখে দেয়।
কামাল ভাইকে বলেছিলাম এক সঙ্গে নিঝুম দ্বীপে যাব। কামাল উদ্দিন আহম্মদ জনকন্ঠের স্টাফ রিপোর্টার। তার কাজের ক্ষেত্র বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও প্রবীন সাংবাদিক। ষাটোর্ধ বয়স তাঁর। এখনো ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামে, চর থেকে চরে, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। অভিজ্ঞতার ঝুলি তার অনেক। তাঁর সহচার্য পাওয়া নবীন সংবাদ কর্মীদের জন্য একটা বড় পাওনা। বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। সম্প্রতি এক পীরের মুরিদ হয়েছেন। লম্বা দাড়ি, লম্বা পাঞ্জাবী, পাগড়ি বাঁধার দীর্ঘ সবুজ কাপড়, সেলাইবিহীন লুঙ্গি আর সার্বক্ষনিক টুপি পরা তাকে দেখে অনেকেই এখন হোঁচট খেয়ে পড়েন। এক সময়ের কেতাদুরস্ত মানুষটির সঙ্গে এখন অনেকেই হিসাব মিলাতে পারেন না। সেই কেতাদুরস্ত কামাল ভাইয়ের মধ্যে ঘটে গেলো অদ্ভুত রূপান্তর। সরকারী বেসরকারী অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাইজদী শহরে কামাল নামে আরো আছেন। তিনি ইংলিশ কামাল বলেই সমধিক পরিচিত। সম্ভবত কারো সঙ্গে আলাপচারিতায় শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলেন বলে তার এই নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর সময়ের সঙ্গে আমার সময় মিলছে না। তাই অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই নিঝুম দ্বীপ যাব। পথ জানাই আছে। সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সবচেয়ে নিরাপদ শীতকালে। অন্য সময় সাগর রুদ্র হয়ে উঠে। সোনাপুর থেকে সোজা দক্ষিনে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার চর মজিদে হাতিয়া স্টিমার ঘাট। পাকা প্রশস্ত রাস্তা। বাস কিংবা টেম্পুতে যাওয়া যায়। বাস ভাড়া আঠারো টাকা, টেম্পু ভাড়া পঁচিশ টাকা। বেবী টেক্সীতেও যাওযা যায়। ভাড়া বেশী এই যা। ঘাটে সব সময় ট্রলার পাওয়া যায় না। নদীতে পলি জমে চড়াই উঠে আছে। তাই জোয়ার ছাড়া ট্রলার ছাড়ে না। জোয়ারের হিসাব করেই যেতে হয়। ডিসেম্বরের শেষ। শীতও জেঁকে বসেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম এখনই সময়। খোঁজ নিয়ে জানলাম আজ দুপুর দু’টায় জোয়ার। মাইজদী থেকে অন্ততঃ দু’আড়াই ঘন্টা আগে বেরুতে হবে।
হাতিয়া নিঝুমদ্বীপে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দু’চার দিন থাকার ইচ্ছে আছে। দিল্লীর ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফিক কাউন্সিল থেকে পাওয়া একটি ছোট্ট ক্যামেরা ব্যাগ, সাইড পকেটে টুথ ব্রাশ, পেস্ট আর ব্যাগে ক্যামেরা, জুমল্যান্স, ফিক্সড ল্যান্স ক্যামেরা থাকার পরও কিছু জায়গা থাকে, ওতেই গরম কাপড় নিয়ে নিলাম। ঠেসে ঢুকানোতে ব্যাগও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হাতে সময় রেখেই বাসা থেকে বের হলাম। রৌদ্র ও বৃষ্টি কাছ থেকে ছুটে আসতে কম ঝামেলা হয়নি। জোয়ারের বেশ আগেই ঘাটে এসে পৌঁছলাম। কিছুটা সময় পেয়ে পাশেই মাহফুজ ভাইয়ের চায়ের দোকানে পা বাড়াতেই দেখি আমাকে দেখে নিজেই তার দোকানে নেয়ার জন্য ছুটে আসছেন। তিনি ভূমিহীন কৃষক নেতা। এক টুকরো চাষের জমি পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। নতুন জমি উঠলেই জোতদাররা জমি দখল করছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন তাঁরা। জেল জুলুম সহ্য করেছেন বহুবার। এববার ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে উপজেলা ঘেরাও করেছিলেন। সেই থেকে নাম হয়েছে উপজেলা মাহফুজ। অত্যন্ত সাধারন নড়বড়ে একটি ছোট্ট খুঁটির দোকান। সামনে তক্তা দিয়ে বসার জায়গা আছে। ওতেই বসলাম। একটি ময়লা বিবর্ণ জামা পরে তার রোগা মেয়েটি শীর্ন হাতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিলো।
মাহফুজ ভাই স্নেহ মাখা সুরে বললেন- ‘চা-খান’।
গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে তাকাচ্ছিলাম পাশেই বয়ে যাওয়া ক্ষীনস্রোতা নদীর দিকে। এক সময় প্রমত্তা মেঘনা উন্মাতাল হতো এখানে। এটি এখন মেঘনা নদীর শাখা। তখন ছিল ভাটার সময়। ওপারে জেগে উঠেছে বিশাল বয়ার চর। সেদিকে তাকিয়ে বললাম-
‘মাহফুজ ভাই জোয়ার কখন আসবে’ ?
‘এইতো অনই চলি আইবো, কোনাই যাইবেন নি’?
‘একটু নিঝুম দ্বীপ যেতে চাচ্ছি’।
‘হাইরবেন, সী ট্রাকে না ট্রলারে যাইবেন, আর কেও আছে নি’?
‘না আমি একাই’।
ঘাটে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে। ইতিউতি ঘুরছে কেউ কেউ। এক সময় নদীর ভাঁটার স্রোত থেমে গেল। জোয়ার আসছে। পানি স্রোত উল্টোমুখী হয়ে ঘুরে গেলো। মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে কোন কথা হয়নি। উঠতেই বললেন-
‘আইজগা থাকি যান’।
ঠিক আছে আরেকদিন থাকা যাবে, আজ ঘুরে আসি অনেক দিন যাওয়া হয় না। এতক্ষনে জোয়ারের পানি ঘাটে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে ঘাটের মানুষগুলো। হাতিয়া থেকে ছেড়ে আসা কয়টা ট্রলার বিকট আওয়াজ করে ঘাটের দিকে এগিয়ে এলো। এটিকে ঠিক ঘাট বলা যাবে না। একটি লম্বা তক্তা ফেলা হয়েছে ট্রলারের ওপর থেকে। সেই তক্তার ভাঁজে ভাঁজে আড়াআড়ি কাঠের টুকরো পেরেক দিয়ে লাগিয়ে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। ওপর থেকে একজন একটি বাঁশের লগি ধরে আছে। এক মাথা তার কাঁধে অন্য মাথা মাটিতে ঠেকানো। সিঁড়ি এসে নেমেছে হাঁটু পানিতে। লোকজন সেই সিঁড়ি বেয়ে লগি ধরে নামছে। যাত্রী নামা হয়ে গেলে এবার ওঠার পালা। আবার এভাবেই হাঁটু পানিতে নেমে সবাই ট্রলারে উঠছে। প্যান্ট গুটিয়ে জুতা হাতে করে ব্যাগ কাঁধে আমিও উঠে পড়লাম ট্রলারে। ক’জন স্বল্প পরিচিত মানুষের মুখ দেখতে পেলাম। মাইজদীতে মাঝে মাঝে ওদের দেখি। ক’জন উৎসুক হয়ে উঠলো। এ পথে এ সময় সৌখিন পর্যটকদের বেশ আনাগোনা হয়। ওদের দেখেই সবাই চিনে নেয়। এখান থেকে বন বিভাগ ও সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা যাবার ব্যবস্থা আছে। কেউ কেউ স্পিড বোট ব্যবহার করেন। জোয়ার থাকতে থাকতেই ট্রলার ঘাট ছেড়ে দিল। ট্রলারটি ততক্ষনে পূর্ব মুখী হয়ে বয়ার চর ঘেঁষে চলতে শুরু করলো।
ট্রলারের ভিতরে যাত্রীদের বসার জায়গা আছে। ওপরে ঠাসাঠাসি করে পাটাতনে বসেছে অনেক যাত্রী। আমিও ওদের সঙ্গে মিশে গেলাম। ট্রলারের মাশুল ধরে আছে মধ্য বয়সী লম্বা দেহের এক সুঠাম দেহী সারেং। রৌদ্রে পোড়া শরীর। মুখসহ শরীর তামাটে রং ধরেছে। মুখ ভরা লম্বা দাঁড়ি। হাতের মুঠিতে বৈঠা আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার সামনে। তার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে এক দুর্নিবার আর্কষণ বোধ করলাম। এক পা দু’ পা করে কখন যে কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি নিজেও বুঝতে পালামনা। খুব একটা কথা বলছে না। একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়েই আবার সামনে চোখ রাখলো। হাঁটু থেকে একটু নামানো লুঙ্গি। গায়ে ময়লা পলিয়েস্টারের বেঁটে পাঞ্জাবী। বুকের এক পাশে পানের পিকের লম্বা দাগ। কপালে আর চোখের নিচে দুটো গর্ত। আঘাত না বসন্তের দাগ বোঝা গেলো না। ট্রলার চলছিল তখন বন বিভাগের ফরেস্ট জোনের পাশ দিয়ে। চরবাটার বিশাল ফরেস্ট। কয়টি নাদুসনুদুস গরু আর মহিষ চরছিলো। আমাদের দিকে নাক উঁচিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নিলো। ততক্ষণে ট্রলারটি বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখী হলো। সারেং শক্তহাতে বৈঠা ধরে আছে। নদীর এইখানটায় কয়টি মারাত্মক খাড়ি আছে। অসাবধানতায় যে কোন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
সারেং-এর আরো কাছে গিয়ে বল্লাম, ‘হাতিয়া কতক্ষন লাগবে’।
‘এই ধরেন না এক ঘন্টা।’
সারেং- এার সাথে আলাপ জমাতে চাইলাম। সারেং নিজেই জানতে চাইলো-
‘হাতিয়া বেড়াইতে যাইবেন নি’।
হ্যাঁ, এই ঘুরাফেরা, বেড়ানো, দেখা।
পাশে কয়টা মালের বস্তা। তার উপর হাঁটুর মৃদু ঠেস দিয়ে বললাম- ‘ট্রলারটা কি আপনার’?
একটু মৃদু হেসে আপন মনেই বললেন- ‘আমার কেমনে অইবো, কোম্পানির’।
কতবছর আছেন এই কাজে।
‘বার তের বছর’।
ঘর বাড়ী কোথায়-
‘এই সাগরে, সাগরাইতো আমাগো ঘর বাড়ি’।
না মানে-জায়গা জমিন বৌ ঝি ছেলে মেয়ে-
‘জায়গা জমিন নাই, চর সুলুকীয়ায় একটা ভিটায় থাকে আমার পরিবার। হে একটা পোলারে পালে। তারে লই থাকে’।
জায়গা জমিন করেন নাই? সরকার তো অনেক জায়গা দিচ্ছে।
একটা উদাস চাহনী মেলে দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন-
‘জায়গা জমির দরকার নাই আঁর’।
একটা চাপা ক্ষোভ আর দুঃখ উথলে উঠলো তাঁর কন্ঠ থেকে।
কি ব্যাপার-
‘ব্যাপার হুনি আর কি অইবো-
তবুও বলেন না শুনি।
‘ভাটির টেক চিনেন নি। অন সরকারে নাম দিছে নবগ্রাম। হিয়ানে সতর আঠারো বছর আগে একটা ঘটনা অইছিলো’।
আমি বললাম- ‘হুঁ একটু একটু কানে এসেছিলো। এখন যেমন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে তখন তো ছিলোনা। তখন নতুন চর। অনেকটা দুর্গম ছিলো’।
সারেং থেমে থেমে কথা শুরু করে।
‘নদীয়ে একদিকে ভাঙে আরেকদিকে চর দেয়। আল্লার দান। মানুষ হেই চরে যাই নতুন জমি লায়েক করে। চাষ করে। অশিক্ষিত চাষীরা জমিনের নথিপত্র এতাগিন বুঝেনি। চাষ কইল্লে ধান হইবো, হেতারাতো এগেইনই জানে। হেই ভাটির টেকে নতুন চর উঠলে শাহবাজপুরের তুন হাতিয়ার তুন নদীভাঙা কোগা মানুষ পরিবার লই আইছিলো। আল্লাহরতান জমি, হড়ি রইছে, হেতারা আই জমিন গুলান লায়েক করি চাষ শুরু কইচ্ছে। চর লক্ষ্মীর বড় মিয়ার চোখ পইড়ছে হেই জমিনে। এতারা তিরিশ বত্তিরিশগা পরিবার। হেতেন কইলো উডি যাইতে। এতারা কই যাইবো। এতাগো জাগা জমিন বেক নদীয়ে খাই ফালাইছে। শেষমেষ বড় মিয়ায় আঙ্গো উন্নিশ জনরে ধরাইলো। পাঁচশ’ করি চুক্তি। অগ্রিম দিছে দুইশ’ করি। কাম অই গেলে হরের গুন দিবার কতা। আঁর লগে কতা, জমিন কিছু আঁরেও দিব’।
একটা বড় ঢেউ এসে সজোরে ধক্কা খেলো ট্রলারে। সাগরের কিছু জল ছিটকে এসে আছাড় খেলো ট্রলারের উপর। ট্রলারটা এদিক ওদিক একটু দোল খেয়ে উঠলো।
‘আঁর এক বইন আছিলো। শেফালী। ইজারে আঁই কোলে কোলে রাইখতাম। বাপ মরি যাইবার সময় হেতেনে আঁর হাতে দি গেছে।’
একটু থামলো সারেং। যেন দম নিল। উদাস দৃষ্টি নিয়ে বলল- ‘আমারে ছাড়া থাইকতনা। বাবা মরার ক’দিন পরে মাও মরি গেছে, হেইতুন আঁই তার মা-বাপ। জোলেখা আঁর মামতো বইন। মায়ে বৌ করি পরে আইনছে হেও খুব আদর কইত্তো। এক খেঁতার নিচে বইনরে আমি রাইখতাম।’
একটা জলের ঘুর্ণির পাশ কেটে ট্রলার বাঁক নিল দক্ষিণে। ফেনী নদীর পানি আর নোয়াখালী খালের পানি এসে এখানে জলের প্রচন্ড ঘুর্ণি সৃষ্টি হয়েছে। ছোটখাট নৌকা এসে পড়লে নিস্তার নেই। ক’বছর আগে এক মহিষের বাথানের মালিক এখানে ডুবে মারা যায়। দু’দিন পর তার লাশ ইলিশের জালে এসে ঠেকেছিলো। বয়ার চরের হোগলা পাতার বনের ফাঁকে ফাঁকে মহিষের বাথান। শত শত মহিষ এখানে মনের আনন্দে উরি আর নলখগড়া খেয়ে চরছে। বাথানিয়ারা এখানে এসে মহিষের দুধ সংগ্রহ করে। কিন্তু বন বিভাগ তাদের অঞ্চলে মহিষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিপুল সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এগুলো। দুপাড়ের দৃশ্য দেখে কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
‘চা খাইবেন নি’ সারেং বোধ হয় আমার মনের অবস্থা বুঝেছিল- আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই হাঁক দিল,
‘রফিক-স্যার রে চা দে-’
বৈঠার নিচেই চা বানানোর সরঞ্জাম। টুং টুং আওয়াজ হচ্ছে ওখানে, একটু পরেই কাপ ভর্তি চা এলো। খাঁটি ঘন দুধের চা- অপূর্ব। একটা গাঙ চিল অনেকক্ষন ধরে ট্রলারের পিছনে উড়ে উড়ে আসছিলো দু’একবার পানিতে ঝাঁপ দিয়েও কিছুই পেলো না সে। আমি বললাম-
‘চা খাওয়াচ্ছেন আপনার নামতো জানা হলো না’।
‘ওসমান সারেং।’
সারেং আবার শুরু করলো তার কথা। ‘বইনের নাম আছিলো শেফালী বেগম। সাহবাজপুরে এক গিরস্ত ঘর দেখি বিয়া দিছি। হোলাগা খুব বালা আছিলো। চাইর কানি জমিন আছিলো জামাইগো’।
মাথার ওপর দিয়ে কয়টা অতিথি পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।
‘বিয়ের পর আর খোঁজ নেননি’?
‘হেঁইক্কা নিতাম হারি ন। মইধ্যে মইধ্যে খবর রাইখছি। একবার হুইনছি শাহবাজপুর ভাঙ্গি যার, খবর পাঠাইছিলাম হোতাগোরে, হেগুন আইয়েনো, হেতাগো জাগা জমিন হেই নদীতে খাই ফালাইছে। কোনাই গেছে আর খবর জানি না।
হু হু করে একটা ঠান্ডা বাতা বয়ে গেলো। দূরে কয়টা ছোট ছোট জেলে নৌকা। আরো দক্ষিনে সমুদ্র দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে। সারেং-এর চোখের দিকে তাকালাম-একটা নীল কষ্ট যেন জমা হয়ে আছে ওখানে।
‘বড় মিয়া লোক পাঠাইলো। হেই রাইতে যাইতে অইবো। আমরা উনিশ জন ছ্যাল বললাম লই রওনা দিলাম ভাটির টেকের দিকে’।
একটা ঢোক গিল্লো ওসমান সারেং। কিছু যেন আটকে গেছে গলায়।
‘নিশিথ রাইতে হেই মানুষগুলা গুমাই আছিলো। আমরা টক্কা দি পইড়লাম বস্তিতে। আগুন লাগাই বল্লম ছ্যাল দি গাঁইয়াই গাঁইয়াই হোতাই দিছি হিমড়ার মতন। কোগা দাই গেছে চাইরমুই। মেলা জমি আছিলো ইয়ানে, বড় মিয়া ছাইছিলো হেতেনে জমিগুন তার দখলে রাইখবো, আঁরেও কিছু দিব কইছিলো’।
একটু থামলো সারেং।
‘বেক জন থাইমছে, চেরাগের বাত্তি দি লাশ গুলারে চাইলাম। কাইত্তি চিত্তিই পড়ি রইছে। ঠাস করি একটা বেডির লাশের সামনে আসি কইলজা ছেঁৎ করি উইঠলো। এইডা কি দেইখতাছি। আঙ্গো শেফালী। রক্তের মইধ্যে মরি হুতি রইছে। চেরাগের বাত্তির হরে নাক ফুল চিক চিক কইত্তে আছে। বিয়ার সময় রামগতি বাজার তুন হেতির লাই কিনছিলাম’।
দু’ফোঁটা অশ্রু টপ টপ করে ঝরে পড়লো ওসমান-সারেং এর চোখ বেয়ে। ঠিক সে সময় একটা দমকা বাতাস সেই অশ্রুফোঁটাকে ঊড়িয়ে নিয়ে সাগরের নীল জলে মিশিয়ে দিলো। যেন ওসমানের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুগুলোই এই বিশাল সাগরের জলরাশি। এক অব্যক্ত হাহাকার যেন সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে মিলিয়ে গেলো দূর দিগন্তে।
কিছুক্ষন চুপ থেকে ওসমান বলতে শুরু করলো।
‘আর হিয়ানে যাই ন। বুকের মইধ্যে দোজকের আগুন জইল্লো। দড়ি যাই চর লক্ষ্মী সাগরের কাছে আসি বইসলাম। হিয়ানের তুন একটা সম্পানে করি টেকনাফ চলি গেলাম’।
পুলিশ টুলিশ আসে নি? কেইছ হয়নি?
‘পুলিশ আইছিলো কেইছও অইছে। আঁই কিল্লাই বাদ হইড়ালাম বুইজলাম না। কোগার যাবজ্জীবন জেল অইছে। বুকের জ্বালা লই আঁই গুইরতে আছি সাগরে সাগরে। খালি মাতা আছড়াইতে আছি। আঁই কি কইল্লাম।
আপনার বৌ কোথায়? ছেলে মেয়ে?
‘পরিবার আছে। পোলা মাইয়া অয় ন। হেতি খালি কাইনতো। টেকনাফের চরে ওগ্ গা হোলারে হাইছিলাম। সুন্দর ছেয়ারা। হোলার কেও নাই। হিজারে লই আনি দিচ্ছি জোলেখারে। হেতিয়ে হিজারে হালে। ইস্কুলে ভর্তি করাই দিছে’।
বাড়িতে যান না-
‘মাইধ্যে মাইধ্যে যাই। মাটিতে ঠ্যাঙ লাইগলে কইলজা ছ্যাঁত করি উঠে। এই মাডির লাই কিল্লাই মাইনষের কামড়া কামড়ি।’
দূর সমুদ্রের প্রান্ত ছুঁয়ে একটা কুয়াশার টানা রেখা দু’প্রান্তে দু’দিকে মিশে গিছে। ঐদিকে দৃষ্টি দিয়ে উদাস হয়ে সারেং বলতে লাগলো-
‘আঁই তো মরি গেছি, আঁর কবর আজাব ছইলতে আছে, ঐ জাগা জমিনরে লাতি মারি, হেসাব করি। এই আঁরে যেই ওসমান দেইখতে আছেন এই ওসমান হেই ওসমান ন। ইজা আরুগ্ গা। হিজা মরি শইল্লের মইধ্যে আরুগ্ গা ‘ওসমান’ জনম লইছে’।
একটা অব্যক্ত কান্না ঝরে পড়লো তার কন্ঠে। যে মাটির জন্য ওসমান একদিন হন্যে হয়ে গিয়েছিলো, হয়ে উঠেছিলো হিংস্র শ্বাপদ। সে মাটির প্রতি এখন তার তীব্র ঘৃনা। কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে অসম্ভব পরিবর্তন করে দেয়। সেই চির পরিচিত মানুষের ভিতরই জন্ম নেয় আরেকটা মানুষ। ওসমানের ভিতর আর একটা নতুন ওসমান জন্ম নিল। প্রশ্ন জন্ম দেয় দেহের মধ্যেই কি জন্ম-মৃত্যুর প্রক্রিয়া চলে? একই দেহের ভিতর একই মানুষের কি ভিন্ন রূপে পুনঃ জন্ম হয়? একই দেহের ভিতর কেমন করে মানুষের অদ্ভুত রূপন্তর ঘটে! জানার আকাঙ্খা জাগে, সেই দেহটাই বা কি আর তার ভিতর নিয়ত যে মানুষ জন্ম নিচ্ছে সেই মানুষটাই বা কে?
নীল সাগরের বিশাল জলরাশিতে ওসমানের নীল চাপা কান্নার ধ্বনি আছড়ে পড়ে। সেই কান্না শুনে দেহ ও দেহের ভিতর মানুষের জন্ম-মৃত্যুর রহস্যও কেউ কি খুঁজে পাবে? দূরে হাতিয়ার বাতানখালী ঘাট দেখা গেল। অল্পক্ষণ পরেই একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘাটে এসে ভিড়লো ট্রলার।
মুক্তকন্ঠ
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯
মাহমুদুল হক ফয়েজ
অনেক বার ভেবেছি নিঝুম দ্বীপ যাব। কিন্তু যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠে না। যারা গেছে তারা এই দ্বীপকে হাতিয়ার দক্ষিনে সাগর থেকে জেগে ওঠা এক রহস্যময় দ্বীপ হিসেবেই জানে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সীমাহীন জলরাশি উপকূলে আছড়ে পড়ার দৃশ্যের কথা কল্পনা করে কার না মন ছুটে যায়।
মাত্র কিছুদিন আগেও এটি ছিল দুর্গম দ্বীপ। এখন নোয়াখালীর মাইজদীকোর্ট থেকে পাকা রাস্তা চলে গেছে চর মজিদ হাতিয়া স্টিমার ঘাটে। সেখান থেকে সরকারী সী ট্রাক অথবা ট্রলারে হাতিয়া হয়ে সহজে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। চর মজিদ থেকে স্পিড বোটে সরাসরিও যাওয়া যায়। বাবার অনুরোধে আমি যখন চট্রগ্রামের খাতুনগঞ্জের জমজমাট ব্যবসা ছেড়ে দেশের বাড়ী নোয়াখালী চলে আসলাম, তখন অসুস্থ বাবার কাছে থাকার মানসেই তার কাছে গ্রামে চলে আসা। দীর্ঘদিনের সাজানো ব্যবসা ছেড়ে আসতে কিছুটা কষ্ট হয়েছিলো বৈকি। কিন্তু মাইজদী এসে পুরানো বন্ধু বান্ধব, আমার শৈশবের গ্রাম লক্ষ্মীনারায়নপুর আর দক্ষিনের চরের আইলে আইলে যতই ঘুরেছি ততই বিমোহিত হয়েছি। উপকুলের প্রতি পদে পদে আর ধুলিকণায় অফুরন্ত সোনালী সম্পদ। একটু খোঁচা দিলেই বেরিয়ে পড়ে রাশি রাশি চক্ চকে সোনা।
বাবা গত হয়েছেন দু’বছর। আম্মা আমাকে ছাড়া অস্থির হয়ে ওঠেন। তাকে কিছুক্ষনের জন্য ঘরে রেখে যেতেও তার কাছে বলে যেতে হয়, আমি কোথায় যাচ্ছি, আবার কখন ফিরবো। আর খুব বলে কয়ে বুঝিয়ে যেতে হয় আমার সন্তানদ্বয় রৌদ্র আর বৃষ্টিকে। বৃষ্টির সাত বছর একটু বুদ্ধি হয়েছে। তবে তিন বছরের রৌদ্রকে বুঝিয়ে বাগে আনতে বেশ কষ্ট হয়। শেষমেষ চকলেটের বায়না নিয়ে ঘর থেকে বেরুতে হয়। বায়না শুধু তার জন্য নয় তার আপু, দাদু, আম্মু, মাহবুবের জন্যও আনতে হবে। এই কথা ভেবে আমার খুব ভাল লাগে যে, এতটুকু বয়সে সে সবাইকে নিয়ে ভাবছে। কোন দিন যদি শুধু একটি চকলেট নিয়ে আসি তাহলে সামনের নতুন উঠা দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবাইকে দিয়ে থুয়ে তার ভাগটি খুব ছোটই হয়ে যায়। তখন চকলেটের কাগজ জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে বাড়তি স্বাদটুকুও নিয়ে নেয়। আমি এগুলো দেখে খুব উপভোগ করি। সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষে মিলিয়ে যায়। বৃষ্টির ছিল বাতাসার বায়না। এখন অবশ্য বায়না পাল্টিয়ে হয়েছে রং পেন্সিল। প্রায়ই তা হারাবে আর মাহবুবকে খাটের নিচে টেবিলের নিচে ঘরের কোণায় কোণায় হাতড়িয়ে ভাঙাচোরা পেন্সিলগুলো খুঁজে আনতে হয়। মাহবুবও ছবি আঁকে, এগুলো তার ভান্ডে জমা হয়ে যায়। সে খুব যত্ন করে এগুলো তার কাছে রেখে দেয়।
কামাল ভাইকে বলেছিলাম এক সঙ্গে নিঝুম দ্বীপে যাব। কামাল উদ্দিন আহম্মদ জনকন্ঠের স্টাফ রিপোর্টার। তার কাজের ক্ষেত্র বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও প্রবীন সাংবাদিক। ষাটোর্ধ বয়স তাঁর। এখনো ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামে, চর থেকে চরে, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। অভিজ্ঞতার ঝুলি তার অনেক। তাঁর সহচার্য পাওয়া নবীন সংবাদ কর্মীদের জন্য একটা বড় পাওনা। বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। সম্প্রতি এক পীরের মুরিদ হয়েছেন। লম্বা দাড়ি, লম্বা পাঞ্জাবী, পাগড়ি বাঁধার দীর্ঘ সবুজ কাপড়, সেলাইবিহীন লুঙ্গি আর সার্বক্ষনিক টুপি পরা তাকে দেখে অনেকেই এখন হোঁচট খেয়ে পড়েন। এক সময়ের কেতাদুরস্ত মানুষটির সঙ্গে এখন অনেকেই হিসাব মিলাতে পারেন না। সেই কেতাদুরস্ত কামাল ভাইয়ের মধ্যে ঘটে গেলো অদ্ভুত রূপান্তর। সরকারী বেসরকারী অনেক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাইজদী শহরে কামাল নামে আরো আছেন। তিনি ইংলিশ কামাল বলেই সমধিক পরিচিত। সম্ভবত কারো সঙ্গে আলাপচারিতায় শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলেন বলে তার এই নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর সময়ের সঙ্গে আমার সময় মিলছে না। তাই অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই নিঝুম দ্বীপ যাব। পথ জানাই আছে। সমুদ্র পাড়ি দেয়ার সবচেয়ে নিরাপদ শীতকালে। অন্য সময় সাগর রুদ্র হয়ে উঠে। সোনাপুর থেকে সোজা দক্ষিনে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার চর মজিদে হাতিয়া স্টিমার ঘাট। পাকা প্রশস্ত রাস্তা। বাস কিংবা টেম্পুতে যাওয়া যায়। বাস ভাড়া আঠারো টাকা, টেম্পু ভাড়া পঁচিশ টাকা। বেবী টেক্সীতেও যাওযা যায়। ভাড়া বেশী এই যা। ঘাটে সব সময় ট্রলার পাওয়া যায় না। নদীতে পলি জমে চড়াই উঠে আছে। তাই জোয়ার ছাড়া ট্রলার ছাড়ে না। জোয়ারের হিসাব করেই যেতে হয়। ডিসেম্বরের শেষ। শীতও জেঁকে বসেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম এখনই সময়। খোঁজ নিয়ে জানলাম আজ দুপুর দু’টায় জোয়ার। মাইজদী থেকে অন্ততঃ দু’আড়াই ঘন্টা আগে বেরুতে হবে।
হাতিয়া নিঝুমদ্বীপে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দু’চার দিন থাকার ইচ্ছে আছে। দিল্লীর ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফিক কাউন্সিল থেকে পাওয়া একটি ছোট্ট ক্যামেরা ব্যাগ, সাইড পকেটে টুথ ব্রাশ, পেস্ট আর ব্যাগে ক্যামেরা, জুমল্যান্স, ফিক্সড ল্যান্স ক্যামেরা থাকার পরও কিছু জায়গা থাকে, ওতেই গরম কাপড় নিয়ে নিলাম। ঠেসে ঢুকানোতে ব্যাগও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হাতে সময় রেখেই বাসা থেকে বের হলাম। রৌদ্র ও বৃষ্টি কাছ থেকে ছুটে আসতে কম ঝামেলা হয়নি। জোয়ারের বেশ আগেই ঘাটে এসে পৌঁছলাম। কিছুটা সময় পেয়ে পাশেই মাহফুজ ভাইয়ের চায়ের দোকানে পা বাড়াতেই দেখি আমাকে দেখে নিজেই তার দোকানে নেয়ার জন্য ছুটে আসছেন। তিনি ভূমিহীন কৃষক নেতা। এক টুকরো চাষের জমি পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন। নতুন জমি উঠলেই জোতদাররা জমি দখল করছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন তাঁরা। জেল জুলুম সহ্য করেছেন বহুবার। এববার ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে উপজেলা ঘেরাও করেছিলেন। সেই থেকে নাম হয়েছে উপজেলা মাহফুজ। অত্যন্ত সাধারন নড়বড়ে একটি ছোট্ট খুঁটির দোকান। সামনে তক্তা দিয়ে বসার জায়গা আছে। ওতেই বসলাম। একটি ময়লা বিবর্ণ জামা পরে তার রোগা মেয়েটি শীর্ন হাতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিলো।
মাহফুজ ভাই স্নেহ মাখা সুরে বললেন- ‘চা-খান’।
গরম চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে তাকাচ্ছিলাম পাশেই বয়ে যাওয়া ক্ষীনস্রোতা নদীর দিকে। এক সময় প্রমত্তা মেঘনা উন্মাতাল হতো এখানে। এটি এখন মেঘনা নদীর শাখা। তখন ছিল ভাটার সময়। ওপারে জেগে উঠেছে বিশাল বয়ার চর। সেদিকে তাকিয়ে বললাম-
‘মাহফুজ ভাই জোয়ার কখন আসবে’ ?
‘এইতো অনই চলি আইবো, কোনাই যাইবেন নি’?
‘একটু নিঝুম দ্বীপ যেতে চাচ্ছি’।
‘হাইরবেন, সী ট্রাকে না ট্রলারে যাইবেন, আর কেও আছে নি’?
‘না আমি একাই’।
ঘাটে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে। ইতিউতি ঘুরছে কেউ কেউ। এক সময় নদীর ভাঁটার স্রোত থেমে গেল। জোয়ার আসছে। পানি স্রোত উল্টোমুখী হয়ে ঘুরে গেলো। মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে কোন কথা হয়নি। উঠতেই বললেন-
‘আইজগা থাকি যান’।
ঠিক আছে আরেকদিন থাকা যাবে, আজ ঘুরে আসি অনেক দিন যাওয়া হয় না। এতক্ষনে জোয়ারের পানি ঘাটে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে ঘাটের মানুষগুলো। হাতিয়া থেকে ছেড়ে আসা কয়টা ট্রলার বিকট আওয়াজ করে ঘাটের দিকে এগিয়ে এলো। এটিকে ঠিক ঘাট বলা যাবে না। একটি লম্বা তক্তা ফেলা হয়েছে ট্রলারের ওপর থেকে। সেই তক্তার ভাঁজে ভাঁজে আড়াআড়ি কাঠের টুকরো পেরেক দিয়ে লাগিয়ে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। ওপর থেকে একজন একটি বাঁশের লগি ধরে আছে। এক মাথা তার কাঁধে অন্য মাথা মাটিতে ঠেকানো। সিঁড়ি এসে নেমেছে হাঁটু পানিতে। লোকজন সেই সিঁড়ি বেয়ে লগি ধরে নামছে। যাত্রী নামা হয়ে গেলে এবার ওঠার পালা। আবার এভাবেই হাঁটু পানিতে নেমে সবাই ট্রলারে উঠছে। প্যান্ট গুটিয়ে জুতা হাতে করে ব্যাগ কাঁধে আমিও উঠে পড়লাম ট্রলারে। ক’জন স্বল্প পরিচিত মানুষের মুখ দেখতে পেলাম। মাইজদীতে মাঝে মাঝে ওদের দেখি। ক’জন উৎসুক হয়ে উঠলো। এ পথে এ সময় সৌখিন পর্যটকদের বেশ আনাগোনা হয়। ওদের দেখেই সবাই চিনে নেয়। এখান থেকে বন বিভাগ ও সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা যাবার ব্যবস্থা আছে। কেউ কেউ স্পিড বোট ব্যবহার করেন। জোয়ার থাকতে থাকতেই ট্রলার ঘাট ছেড়ে দিল। ট্রলারটি ততক্ষনে পূর্ব মুখী হয়ে বয়ার চর ঘেঁষে চলতে শুরু করলো।
ট্রলারের ভিতরে যাত্রীদের বসার জায়গা আছে। ওপরে ঠাসাঠাসি করে পাটাতনে বসেছে অনেক যাত্রী। আমিও ওদের সঙ্গে মিশে গেলাম। ট্রলারের মাশুল ধরে আছে মধ্য বয়সী লম্বা দেহের এক সুঠাম দেহী সারেং। রৌদ্রে পোড়া শরীর। মুখসহ শরীর তামাটে রং ধরেছে। মুখ ভরা লম্বা দাঁড়ি। হাতের মুঠিতে বৈঠা আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার সামনে। তার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে এক দুর্নিবার আর্কষণ বোধ করলাম। এক পা দু’ পা করে কখন যে কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি নিজেও বুঝতে পালামনা। খুব একটা কথা বলছে না। একবার আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়েই আবার সামনে চোখ রাখলো। হাঁটু থেকে একটু নামানো লুঙ্গি। গায়ে ময়লা পলিয়েস্টারের বেঁটে পাঞ্জাবী। বুকের এক পাশে পানের পিকের লম্বা দাগ। কপালে আর চোখের নিচে দুটো গর্ত। আঘাত না বসন্তের দাগ বোঝা গেলো না। ট্রলার চলছিল তখন বন বিভাগের ফরেস্ট জোনের পাশ দিয়ে। চরবাটার বিশাল ফরেস্ট। কয়টি নাদুসনুদুস গরু আর মহিষ চরছিলো। আমাদের দিকে নাক উঁচিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নিলো। ততক্ষণে ট্রলারটি বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখী হলো। সারেং শক্তহাতে বৈঠা ধরে আছে। নদীর এইখানটায় কয়টি মারাত্মক খাড়ি আছে। অসাবধানতায় যে কোন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
সারেং-এর আরো কাছে গিয়ে বল্লাম, ‘হাতিয়া কতক্ষন লাগবে’।
‘এই ধরেন না এক ঘন্টা।’
সারেং- এার সাথে আলাপ জমাতে চাইলাম। সারেং নিজেই জানতে চাইলো-
‘হাতিয়া বেড়াইতে যাইবেন নি’।
হ্যাঁ, এই ঘুরাফেরা, বেড়ানো, দেখা।
পাশে কয়টা মালের বস্তা। তার উপর হাঁটুর মৃদু ঠেস দিয়ে বললাম- ‘ট্রলারটা কি আপনার’?
একটু মৃদু হেসে আপন মনেই বললেন- ‘আমার কেমনে অইবো, কোম্পানির’।
কতবছর আছেন এই কাজে।
‘বার তের বছর’।
ঘর বাড়ী কোথায়-
‘এই সাগরে, সাগরাইতো আমাগো ঘর বাড়ি’।
না মানে-জায়গা জমিন বৌ ঝি ছেলে মেয়ে-
‘জায়গা জমিন নাই, চর সুলুকীয়ায় একটা ভিটায় থাকে আমার পরিবার। হে একটা পোলারে পালে। তারে লই থাকে’।
জায়গা জমিন করেন নাই? সরকার তো অনেক জায়গা দিচ্ছে।
একটা উদাস চাহনী মেলে দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন-
‘জায়গা জমির দরকার নাই আঁর’।
একটা চাপা ক্ষোভ আর দুঃখ উথলে উঠলো তাঁর কন্ঠ থেকে।
কি ব্যাপার-
‘ব্যাপার হুনি আর কি অইবো-
তবুও বলেন না শুনি।
‘ভাটির টেক চিনেন নি। অন সরকারে নাম দিছে নবগ্রাম। হিয়ানে সতর আঠারো বছর আগে একটা ঘটনা অইছিলো’।
আমি বললাম- ‘হুঁ একটু একটু কানে এসেছিলো। এখন যেমন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে তখন তো ছিলোনা। তখন নতুন চর। অনেকটা দুর্গম ছিলো’।
সারেং থেমে থেমে কথা শুরু করে।
‘নদীয়ে একদিকে ভাঙে আরেকদিকে চর দেয়। আল্লার দান। মানুষ হেই চরে যাই নতুন জমি লায়েক করে। চাষ করে। অশিক্ষিত চাষীরা জমিনের নথিপত্র এতাগিন বুঝেনি। চাষ কইল্লে ধান হইবো, হেতারাতো এগেইনই জানে। হেই ভাটির টেকে নতুন চর উঠলে শাহবাজপুরের তুন হাতিয়ার তুন নদীভাঙা কোগা মানুষ পরিবার লই আইছিলো। আল্লাহরতান জমি, হড়ি রইছে, হেতারা আই জমিন গুলান লায়েক করি চাষ শুরু কইচ্ছে। চর লক্ষ্মীর বড় মিয়ার চোখ পইড়ছে হেই জমিনে। এতারা তিরিশ বত্তিরিশগা পরিবার। হেতেন কইলো উডি যাইতে। এতারা কই যাইবো। এতাগো জাগা জমিন বেক নদীয়ে খাই ফালাইছে। শেষমেষ বড় মিয়ায় আঙ্গো উন্নিশ জনরে ধরাইলো। পাঁচশ’ করি চুক্তি। অগ্রিম দিছে দুইশ’ করি। কাম অই গেলে হরের গুন দিবার কতা। আঁর লগে কতা, জমিন কিছু আঁরেও দিব’।
একটা বড় ঢেউ এসে সজোরে ধক্কা খেলো ট্রলারে। সাগরের কিছু জল ছিটকে এসে আছাড় খেলো ট্রলারের উপর। ট্রলারটা এদিক ওদিক একটু দোল খেয়ে উঠলো।
‘আঁর এক বইন আছিলো। শেফালী। ইজারে আঁই কোলে কোলে রাইখতাম। বাপ মরি যাইবার সময় হেতেনে আঁর হাতে দি গেছে।’
একটু থামলো সারেং। যেন দম নিল। উদাস দৃষ্টি নিয়ে বলল- ‘আমারে ছাড়া থাইকতনা। বাবা মরার ক’দিন পরে মাও মরি গেছে, হেইতুন আঁই তার মা-বাপ। জোলেখা আঁর মামতো বইন। মায়ে বৌ করি পরে আইনছে হেও খুব আদর কইত্তো। এক খেঁতার নিচে বইনরে আমি রাইখতাম।’
একটা জলের ঘুর্ণির পাশ কেটে ট্রলার বাঁক নিল দক্ষিণে। ফেনী নদীর পানি আর নোয়াখালী খালের পানি এসে এখানে জলের প্রচন্ড ঘুর্ণি সৃষ্টি হয়েছে। ছোটখাট নৌকা এসে পড়লে নিস্তার নেই। ক’বছর আগে এক মহিষের বাথানের মালিক এখানে ডুবে মারা যায়। দু’দিন পর তার লাশ ইলিশের জালে এসে ঠেকেছিলো। বয়ার চরের হোগলা পাতার বনের ফাঁকে ফাঁকে মহিষের বাথান। শত শত মহিষ এখানে মনের আনন্দে উরি আর নলখগড়া খেয়ে চরছে। বাথানিয়ারা এখানে এসে মহিষের দুধ সংগ্রহ করে। কিন্তু বন বিভাগ তাদের অঞ্চলে মহিষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিপুল সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এগুলো। দুপাড়ের দৃশ্য দেখে কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
‘চা খাইবেন নি’ সারেং বোধ হয় আমার মনের অবস্থা বুঝেছিল- আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই হাঁক দিল,
‘রফিক-স্যার রে চা দে-’
বৈঠার নিচেই চা বানানোর সরঞ্জাম। টুং টুং আওয়াজ হচ্ছে ওখানে, একটু পরেই কাপ ভর্তি চা এলো। খাঁটি ঘন দুধের চা- অপূর্ব। একটা গাঙ চিল অনেকক্ষন ধরে ট্রলারের পিছনে উড়ে উড়ে আসছিলো দু’একবার পানিতে ঝাঁপ দিয়েও কিছুই পেলো না সে। আমি বললাম-
‘চা খাওয়াচ্ছেন আপনার নামতো জানা হলো না’।
‘ওসমান সারেং।’
সারেং আবার শুরু করলো তার কথা। ‘বইনের নাম আছিলো শেফালী বেগম। সাহবাজপুরে এক গিরস্ত ঘর দেখি বিয়া দিছি। হোলাগা খুব বালা আছিলো। চাইর কানি জমিন আছিলো জামাইগো’।
মাথার ওপর দিয়ে কয়টা অতিথি পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।
‘বিয়ের পর আর খোঁজ নেননি’?
‘হেঁইক্কা নিতাম হারি ন। মইধ্যে মইধ্যে খবর রাইখছি। একবার হুইনছি শাহবাজপুর ভাঙ্গি যার, খবর পাঠাইছিলাম হোতাগোরে, হেগুন আইয়েনো, হেতাগো জাগা জমিন হেই নদীতে খাই ফালাইছে। কোনাই গেছে আর খবর জানি না।
হু হু করে একটা ঠান্ডা বাতা বয়ে গেলো। দূরে কয়টা ছোট ছোট জেলে নৌকা। আরো দক্ষিনে সমুদ্র দিগন্তে গিয়ে মিশে গেছে। সারেং-এর চোখের দিকে তাকালাম-একটা নীল কষ্ট যেন জমা হয়ে আছে ওখানে।
‘বড় মিয়া লোক পাঠাইলো। হেই রাইতে যাইতে অইবো। আমরা উনিশ জন ছ্যাল বললাম লই রওনা দিলাম ভাটির টেকের দিকে’।
একটা ঢোক গিল্লো ওসমান সারেং। কিছু যেন আটকে গেছে গলায়।
‘নিশিথ রাইতে হেই মানুষগুলা গুমাই আছিলো। আমরা টক্কা দি পইড়লাম বস্তিতে। আগুন লাগাই বল্লম ছ্যাল দি গাঁইয়াই গাঁইয়াই হোতাই দিছি হিমড়ার মতন। কোগা দাই গেছে চাইরমুই। মেলা জমি আছিলো ইয়ানে, বড় মিয়া ছাইছিলো হেতেনে জমিগুন তার দখলে রাইখবো, আঁরেও কিছু দিব কইছিলো’।
একটু থামলো সারেং।
‘বেক জন থাইমছে, চেরাগের বাত্তি দি লাশ গুলারে চাইলাম। কাইত্তি চিত্তিই পড়ি রইছে। ঠাস করি একটা বেডির লাশের সামনে আসি কইলজা ছেঁৎ করি উইঠলো। এইডা কি দেইখতাছি। আঙ্গো শেফালী। রক্তের মইধ্যে মরি হুতি রইছে। চেরাগের বাত্তির হরে নাক ফুল চিক চিক কইত্তে আছে। বিয়ার সময় রামগতি বাজার তুন হেতির লাই কিনছিলাম’।
দু’ফোঁটা অশ্রু টপ টপ করে ঝরে পড়লো ওসমান-সারেং এর চোখ বেয়ে। ঠিক সে সময় একটা দমকা বাতাস সেই অশ্রুফোঁটাকে ঊড়িয়ে নিয়ে সাগরের নীল জলে মিশিয়ে দিলো। যেন ওসমানের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুগুলোই এই বিশাল সাগরের জলরাশি। এক অব্যক্ত হাহাকার যেন সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে মিলিয়ে গেলো দূর দিগন্তে।
কিছুক্ষন চুপ থেকে ওসমান বলতে শুরু করলো।
‘আর হিয়ানে যাই ন। বুকের মইধ্যে দোজকের আগুন জইল্লো। দড়ি যাই চর লক্ষ্মী সাগরের কাছে আসি বইসলাম। হিয়ানের তুন একটা সম্পানে করি টেকনাফ চলি গেলাম’।
পুলিশ টুলিশ আসে নি? কেইছ হয়নি?
‘পুলিশ আইছিলো কেইছও অইছে। আঁই কিল্লাই বাদ হইড়ালাম বুইজলাম না। কোগার যাবজ্জীবন জেল অইছে। বুকের জ্বালা লই আঁই গুইরতে আছি সাগরে সাগরে। খালি মাতা আছড়াইতে আছি। আঁই কি কইল্লাম।
আপনার বৌ কোথায়? ছেলে মেয়ে?
‘পরিবার আছে। পোলা মাইয়া অয় ন। হেতি খালি কাইনতো। টেকনাফের চরে ওগ্ গা হোলারে হাইছিলাম। সুন্দর ছেয়ারা। হোলার কেও নাই। হিজারে লই আনি দিচ্ছি জোলেখারে। হেতিয়ে হিজারে হালে। ইস্কুলে ভর্তি করাই দিছে’।
বাড়িতে যান না-
‘মাইধ্যে মাইধ্যে যাই। মাটিতে ঠ্যাঙ লাইগলে কইলজা ছ্যাঁত করি উঠে। এই মাডির লাই কিল্লাই মাইনষের কামড়া কামড়ি।’
দূর সমুদ্রের প্রান্ত ছুঁয়ে একটা কুয়াশার টানা রেখা দু’প্রান্তে দু’দিকে মিশে গিছে। ঐদিকে দৃষ্টি দিয়ে উদাস হয়ে সারেং বলতে লাগলো-
‘আঁই তো মরি গেছি, আঁর কবর আজাব ছইলতে আছে, ঐ জাগা জমিনরে লাতি মারি, হেসাব করি। এই আঁরে যেই ওসমান দেইখতে আছেন এই ওসমান হেই ওসমান ন। ইজা আরুগ্ গা। হিজা মরি শইল্লের মইধ্যে আরুগ্ গা ‘ওসমান’ জনম লইছে’।
একটা অব্যক্ত কান্না ঝরে পড়লো তার কন্ঠে। যে মাটির জন্য ওসমান একদিন হন্যে হয়ে গিয়েছিলো, হয়ে উঠেছিলো হিংস্র শ্বাপদ। সে মাটির প্রতি এখন তার তীব্র ঘৃনা। কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে অসম্ভব পরিবর্তন করে দেয়। সেই চির পরিচিত মানুষের ভিতরই জন্ম নেয় আরেকটা মানুষ। ওসমানের ভিতর আর একটা নতুন ওসমান জন্ম নিল। প্রশ্ন জন্ম দেয় দেহের মধ্যেই কি জন্ম-মৃত্যুর প্রক্রিয়া চলে? একই দেহের ভিতর একই মানুষের কি ভিন্ন রূপে পুনঃ জন্ম হয়? একই দেহের ভিতর কেমন করে মানুষের অদ্ভুত রূপন্তর ঘটে! জানার আকাঙ্খা জাগে, সেই দেহটাই বা কি আর তার ভিতর নিয়ত যে মানুষ জন্ম নিচ্ছে সেই মানুষটাই বা কে?
নীল সাগরের বিশাল জলরাশিতে ওসমানের নীল চাপা কান্নার ধ্বনি আছড়ে পড়ে। সেই কান্না শুনে দেহ ও দেহের ভিতর মানুষের জন্ম-মৃত্যুর রহস্যও কেউ কি খুঁজে পাবে? দূরে হাতিয়ার বাতানখালী ঘাট দেখা গেল। অল্পক্ষণ পরেই একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘাটে এসে ভিড়লো ট্রলার।
মুক্তকন্ঠ
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯
No comments:
Post a Comment