আন্তা বিক্রেতা আমীর আলী
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
গ্রাম-গঞ্জের কত বিচিত্র পেশার মানুষ তাদের সারা জীবন কাটিয়ে দেয় একটি মাত্র পেশা ধরে। কত রাজনৈতিক ওল্টপালট হয়, কতবার কতভাবে সমাজ ভেঙ্গে যাত্রা করে নতুনভাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মড়ক ও বন্যায় পরিবর্তন হয় দৃষ্টিভঙ্গীর। পেশা পরিবর্তন হয় কতজনের। তবু কেউ কেউ পুরান পেশা পুরান ধরন পাল্টাতে পারেননা। এমনি একজন নোয়াখালীর সুধারামের ওলিপুর গ্রামের আমীর আলী। বর্তমানে প্রায় নব্বই বছর বয়স তার। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে ‘আন্তা’ কিনে এনে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন। গ্রামীণ সংস্কৃতি আর অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রতভাবে জড়িত আছে এই ‘আন্তা’। ‘আন্তা’ একপ্রকার মাছ ধরার ফাঁদ। গ্রামের হাওর বিল জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় নানা প্রকার ছোট ছোট মাছ। নানান জাতের নানান প্রজাতির এই মাছগুলো দেখতে যেমন বৈচিত্র্যময় এর স্বাদও তেমন নানান বৈচিত্র্যময়।বর্ষার সময় যখন বিভিন্ন দিকে পানির স্রোত চলাচল করে, মাছগুলোও তখন চঞ্চল হয়ে উঠে, ছুটতে থাকে দিকবিদিক। সেই সময় সরু স্রোতের মুখে বসানো হয় এই ‘আন্তা’। চাই জাতীয় এই আন্তা তৈরিতে বিশেষ প্রক্রিয়া করা থাকে। বাঁশের সরু সরু সলা দিয়ে বাক্সের মত তৈরী করা হয় এটি। দুই দিকে থাকে মাছ ঢুকার বিশেষ ব্যবস্থা। মাছগুলো ভিতরে ঢুকলে আর বের হওয়ার পথ পায়না।
পানির স্রোতের দুই দিকের মাছই আন্তার ভিতরে ঢুকতে পারে।বর্ষার সময় গ্রাম গঞ্জে দেখা যায় অসংখ্য আন্তা বসানো হয়েছে। সাধারনতঃ গ্রামের নারীরাই এই আন্তা বানানোতে পারদর্শী। একটি আন্তা বাজারে বিক্রি হয় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। বৃদ্ধ আমীর আলী বাড়ী বাড়ী ঘুরে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আন্তা গুলো কিনে নেন। আবার মাঝে মাঝে নিজেও তৈরী করেন।
সোনাপুর থেকে বসুর হাট পাকা রাস্তার ওপর আমীর আলীকে দেখা গেলো বড় লাঠির দু পাশে আন্তা গুলোকে বেঁধে কাঁধে করে হাতে একটি হারিকেন নিয়ে ধীর পায়ে যাচ্ছেন দত্তের হাটের দিকে। বাজার সেরে তাঁর বাড়ী ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তাই সঙ্গে থাকে হারিকেন। অন্ধকারে তাঁর অন্যতম সাথী। দত্তের হাটেই সাধারনতঃ আন্তাগুলো বিক্রি করতে আসেন তিনি। সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। বাড়ী থেকে পাঁচ ছয় মাইল দূরের হাটে হেঁটেই আসেন। প্রতি হাটে দু’শ থেকে আড়াই শ’ টাকা বিক্রি হয়। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা লাভ হয় তাঁর। তিনি জানালেন, আগের মত এখন আর তেমন বিক্রি হয়না। মাঠে ঘাটে ছোট মাছ অনেক কমে গেছে। তাই লোকজনও এখন আর তেমন কিনেনা।
প্রায় সারাটা জীবনই তিনি এ পেশায় জড়িত। বৃদ্ধ আমীর আলীর চার ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেরা রিক্সা চালায়। আলাদা সংসার। থাকেও ভিন্ন। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এক মেয়ে স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছে তাঁর কাছে। এখন সে মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী সহ থাকেন।
আমীর আলীর জীবনে কোন বৈচিত্র্য নেই। নিরিহ শান্ত জীবনে কোন কোলাহল নেই। ভাঙ্গা এক চিলতে ঘর। তাতেই তার আনন্দ তাতেই তার সুখ।
মুক্তকঠ
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
No comments:
Post a Comment