১৫ই জুন হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায় নোয়াখালীর শ্রীপুরে
মাহমুদুল হক ফয়েজ
একাত্তরের ১৫জুনে পাকিস্তানি রক্ত পিপাসু হায়নারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নোয়াখালীর সোনাপুরের শ্রীপুর গ্রামে। সেদিন গুলি করে হত্যা করেছিল শতাধিক নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে। ঘরের ভিতর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল অনেক নারী পুরুষ। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে এই গ্রামের অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। কেউ কেউ ভারতে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর প্রায় একমাস নোয়াখালী শত্রু মুক্ত ছিল। সে সময় এ এলাকারই এক দুঃসাহসিক দেশপ্রেমিক তার পরিবহন ট্রাকটি মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে রসদ সরবরাহ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবহনে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি হলেন আলী করিম (তোতা মিয়া)। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। তিনটার সময় ৭টি মিলিটারী ট্রাক ও দু’টি জীপ ভর্তি পাকবাহিনী অতর্কিতে এসে তিন দিক থেকে সমগ্র গ্রাম ঘিরে ফেলে। একদল ঢুকেছিল উত্তরে সরকারী কবরস্থানের পাশ দিয়ে, একদল দক্ষিনে সোনাপুর হয়ে বেড়ীবাঁধ দিয়ে, আর অন্য দল ঢুকেছিল পশ্চিমে আহম্মদিয়া হাইস্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে। গ্রামবাসীরা জানায়, তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল সোনাপুর কারামতিয়া মাদ্রাসার মোদারসের নূর আহম্মদ। আহাম্মদীয়া স্কুলের সামনে তখন আলী করিম (তোতা মিয়া) মুক্তিযুদ্ধ ব্যবহৃত তার স্ই ট্রাকের কাজ করছিলেন। সেই অবস্থায় ঘাতকরা সেখানে তাকে গুলি করে। সাথে সাথে তিনি লুটিয়ে পড়েন। এরপর স্কুলের পিছনে তৎকালীণ আওয়ামী লীগ নেতা হুদা মিয়ার বাড়ীতে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে আর অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকে। একে একে গুলিবিদ্ধ মানুষ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেদিনের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন নোয়াখালী ইউনিয়ন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম খলিল (৫২)। সে দিন হানাদাররা তার দু’ভাই ও চাচাসহ তাদের পাঁচ ছয় জনকে একসাথে বাড়ী থেকে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে।
সেখানেই তার বড় ভাই আবদুর রহমান ও চাচা নুর মোহাম্মদ শহীদ হন। তার পিঠের একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে বুকের সামনে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। বেলায়েত হোসেন মতিন সেদিন হারিয়েছেন তার আপন তিন ভাই, আলী হোসেন, আলী করিম, আলী হায়দারকে। তাদের সঙ্গে নিহত হয়েছিল তার এক আত্মীয় নূর উদ্দিন। মারাত্মক আহত হন আবদুল ওদুদ ও আবদুল আউয়াল। এরা তাদের বাড়ীতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। চৌকিদার বাড়ীতে এক সাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা নৃসংশভাবে তাকে হত্যা করে আবুল খায়ের, ছবির মিয়া, খবির মিয়া, চৌধুরী মিয়া ও বাচ্চু মিয়াকে। নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার ফজলুল হক বাদল জানান, সে সময় ৭২ জনের লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তখন এ গ্রামে আশ্রয় নিতে আসা অনেক নাম না জানা নিহতদের লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আর ঘরের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল অনেকে। গ্রামবাসী জানান, সেদিন ৯৫ জনের লাশ তারা এখানে পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক। সদর থানা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার কামাল উদ্দিন জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে দু’হাজার টাকা করে এককালীন ভাতা প্রদান করেছিলেন কিন্তু এরপর আর কোন সরকার কোন খোঁজ খবর নেয়নি। সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতির স্মরনে নোয়াখালী পৌরসভার চেয়ারম্যান রবিউল হোসেন কচি পৌরসভার পক্ষে এই গ্রামের প্রবেশ পথে ‘স্মৃতি অম্লান’ নামে একটি স্মৃতিস-ম্ভ নির্মাণ করেন। স্মৃতিস্থম্ভটি উদ্বোধন করেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা বি.এল.এফ প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। এ দিবস উপলক্ষে বেলায়েত হোসেন মতিনকে আহ্বায়ক ও ফজলুল হক বাদল, ফুয়াদ হোসেন, কামাল উদ্দিনকে পৃষ্ঠপোষক করে ‘শ্রীপুর গণহত্যা দিবস উদ্যাপন কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
মুক্তকন্ঠ
বৃহষ্পতিবার,১৫জুন,২০০০
No comments:
Post a Comment